হৃদ মাঝারে
– অনির্বাণ সরকার
হৃদ মাঝারে
“হ্যালো, হ্যালো।”
“আবার কেটে গেল। এবারও ফোনে যোগাযোগ করতে পারলাম না।”
“তুমি বরং আর একবার চেষ্টা করে দেখো।”
“Pick up the phone Rajatabha… না এবারও ধরল না। ফোন হয়ে কেটে গেল।”
“আমি বুঝি না, আজকাল ছেলে মেয়েরা যদি ফোন নাই ধরে তাহলে সাথে ফোনটা রাখে কেন? এখনও এলো না ছেলেটা।”
“ওহ বাবা! তুমি বেশি চিন্তা করো না। ডাক্তারবাবু তোমাকে বার বার করে বলেছেন এই বয়সে বেশি চিন্তা না করতে। আর রজতাভ তো কচি খোকা নয়, ঠিক চলে আসবে। বরং এখন গিয়ে একটু বিশ্রাম নাও।”
“না, একদম না।”
“দাদু….. বাবা….. মা….. কাম্মা…..”
“ওই তো দাদুভাই এসে গেছে। হরি ওর মালপত্রগুলো তাড়াতাড়ি ঘরে নিয়ে আসো। যাও যাও।”
“আজ্ঞে বাবু। এখুনি যাইতাছি।”
“হরিকাকা কেমন আছো? বাড়ির সবাই?”
“ভালো দাদাবাবু। সবাই খুব ভালো আছে।”
“এই তো আমার দাদুভাই। এবাবা! তোমার শরীরের একি অবস্থা? মাংস কোথায়? শুধুই হাড্ডি তো।”
“আরে সেসব ছাড়ো। বলি পূজা আর ক-দিন বাকি? মায়ের চক্ষুদান তো হয়নি দেখলাম, তার মানে মহালয়া এখনো পার হয়ে যায় নি।”
“ঠিক ধরেছো। মহালায়া তো পরশুদিন। নিয়ম অনুযায়ী ওইদিনেই মায়ের চক্ষুদান হবে আর তার পরের দিন থেকেই পূজা শুরু হয়ে যাবে। তুমি বরং একটু রেস্ট করে নাও। অনেক কাজ করতে হবে কিন্তু দাদুভাই।”
……………………
মহালয়ার দিন
“বাবা…বাবা…”
“বলো। একটা সমস্যা হয়েছে। অনেক বড় সমস্যা।”
“কী? কী হয়েছে? তাড়াতাড়ি বলো।”
“বলছিলাম যে…”
“আরে বলো না। ধুর!”
“রমেন আর নেই।”
“মানে? কী যা-তা বলছো?”
“হ্যাঁ, বাবা এটাই সত্যি। আমি এইমাত্র খবর পেলাম। আজ সকালেই…” বলেই কেঁদে উঠলো রজতাভর বাবা।
“এখন কী হবে? তবে মায়ের চক্ষুদান কে করবে? হে মা দুগ্গা, এ কোন পরীক্ষায় ফেললে আমাদের?”
রজতাভর বাবা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “তুমি বেশি ভেবো না। নয়তো তোমার শরীর খারাপ করবে। একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই হয়ে যাবে।”
“তুমি কি জানো না যে গত দেড়শ বছর ধরে আমাদের বাড়িতে এই নিয়ম চলে আসছে। তুমি আর দাদুভাই মিলে কিছু একটা ব্যবস্থা করো। দুপুর ১ টা বেজে গেল। সূর্যাস্তের পূর্বে যে মায়ের চক্ষুদান করতেই হবে। হা ঈশ্বর! এ কোন বিপদে পড়লাম আমরা।”
“এখন কলকাতা থেকে একজন শিল্পীকে এখানে নিয়ে আসতেও তো অন্তত সন্ধ্যা ৬ টা বেজে যাবে।”
“না না, সে সম্ভব নয়। ততক্ষণে সূর্য যে অস্ত চলে যাবে।”
……………………
বিকেল ৩ টা
বাড়ির সকলে গভীর চিন্তায় মগ্ন। এমন সময়-
“বলি ও বাবুরা, ফুল লিবেন নাকি?”
“এই মেয়ে কে তুমি? এখানে কী করছো?” রজতাভ বলল।
“আমার নাম উমা আছে বটে। আমি পাইশের গেরামে থাকি গো আর ঘুরি ঘুরি ফুল বিকির করি। লিবা নাকি… ফুল?”
“আমাদের ফুল চাই না। তুমি এখন যেতে পারো।”
“হ, সে ঠিক আছে। কিন্তু তোমাগো সকলে মুখ খান এমন কইরা আছো কেনে?”
“রজতাভ বলে, “আমাদের বাড়ির নিয়ম রয়েছে যে মহালয়ার দিন মায়ের চক্ষুদান সূর্যাস্তের পূর্বেই করতে হয়। আর তারপরের দিন থেকেই মায়ের পুজো শুরু হয়ে যায়। কিন্তু সমস্যার বিষয় এটা যে রমেন মানে যে মায়ের চক্ষুদান করে থাকে সেই শিল্পী আজ সকালে মারা গেছে। তাই মায়ের চক্ষুদান কে করবে এই নিয়ে আমরা বড় চিন্তায় রয়েছি।”
“তু এই ব্যাপার। হা হা হা…”
রজতাভর বাবা উমাকে বললেন, “হাসছো যে বড়ো? তুমি পারবে?”
“হ পারুম তো। মায়ের চোখ আঁকতে হবো আর আমি ওর সন্তান হইয়ে তা পাইরব না?”
“দাদু পেয়ে গেছি।”
“কী পেলে?”
“এই যে মেয়েকে দেখছো, এ মায়ের চক্ষুদান করবে।”
“বলো কী?”
“হ্যাঁ, সত্যি।”
“দেখ মেয়ে, আগে তোমার নামটা বল।”
“দাদু ওর নাম উমা।” উত্তেজনায় রজতাভই নামটা বলে ফেলল।
“আমি তো ওর কাছে শুনতে চেলাম। তোমাকে তো বলতে বলিনি। যে ছেলে খুব একটা কথাই বলতে চায় না, আজ যে সে নিজে থেকে আগ-বাড়িয়ে কথা বলছে। তা, ব্যাপার কী?”
“কই কিছু না তো দাদু।”
“যাক গে, উমা, মা তুমি পারবে তো? ভালো করে ভেবে নাও। এ কিন্তু যে-সে কাজ নয়।”
“হ পারবো গো।”
“না পারলেও কিছু করার নেই। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুক। হে ঈশ্বর তুমি উমার সহায় হও।”
……………………
এরপর ২০ বছর বয়সী উমা মায়ের চক্ষুদান করে এবং তা এতই সুন্দর হয় যে বাড়ির সকলে বিস্মিত হয়ে পড়ে। মনে হয়, স্বয়ং দেবী দূর্গা যেন নিজেই নিজের চোখ আঁকছে। তা দেখে বাড়ির প্রধান অর্থাৎ রজতাভর দাদু উমাকে বলে, “ শোনো উমা, তোমাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না। কাল থেকে পূজা শুরু হবে এবং দশমী পর্যন্ত তা চলবে। সুতরাং, তোমার কোথাও যাওয়া চলবে না। এই কটা দিন এখানেই থাকবে। কেমন?”
“হ।”
এরপর প্রথমা থেকে যে কীভাবে দশমী এসে পরে, তা রজতাভ বুঝতে পারে না। তবে এই কয়েকটি দিনে সে নিজের অজান্তেই যে উমার প্রেমে পড়ে গেছে তা সে ভালোই বুঝতে পেরেছে। উমা মেয়েটিও বেশ সরল প্রকৃতির। হাসিখুশি থাকতেই সে বেশি পছন্দ করে। অনাথ মেয়েটি গ্রামে গ্রামে ঘুরে ফুল বিক্রি করে আর নিজের মত করে চলে। ইতিমধ্যে রজতাভর সাথে উমার প্রেম আরও জমে উঠেছে। প্রতি মুহূর্তে রজতাভ যেন উমাকে অনুভব করতে শুরু করে। ধীরে ধীরে উমাকে সে ভালোবাসতে শুরু করে আর এই কয়েকদিনে খুব দ্রুত ঘটনাগুলো ঘটে যায়। দেখতে দেখতে দশমী চলে আসে। রীতি অনুযায়ী প্রতিবছর ঠিক বিকেল ৪ টায় মায়ের ভাসান হয়। আর সেই ভাসানের অনুষ্ঠানে শুধুমাত্র ছেলেরাই উপস্থিত থাকবে এমনটাই ছিল এই বাড়ির নিয়ম। কোন মহিলাই সেখানে উপস্থিত থাকতে পারেন না। ভাসানের পর যখন সকলে বাড়ি ফিরল। হঠাতই রজতাভর জীবনে ঘটে গেল এক ভয়ঙ্কর ঘটনা। বাড়ি ফিরেই রজতাভ উমা উমা করে ডাকতে শুরু করে, “উমা… উমা… কোথায় তুমি?”
কোন উত্তর না পেয়ে রজতাভ হতাশ হল এবং উমাকে খুঁজতে শুরু করল। তবে অনেকক্ষণ খোঁজার পরেও উমাকে কোথাও না পেয়ে সে বিচলিত হয়ে পড়ে।
“দাদু তুমি কি উমাকে দেখেছো?”
“না তো দাদুভাই।”
“বাবা,মা,কাম্মা, হরি কাকা? আরে কেউ তোমরা দেখ নি। একজন বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেল আর তোমরা জানই না।” দুঃখের সঙ্গে রজতাভ বলল।
রজতাভর বাবা বললেন, “তুমি এত কেন ভাবছো? আছে হয়তো কোথাও। কিংবা হয়তো বাড়ি ফিরে গেছে।”
“বুঝবে না বাবা। কি বললে, বাড়ি?”
“হ্যাঁ, পূজা তো শেষ। তাই হয়তো বাড়িতেই চলে গেছে। কিন্তু আমাদের একবার বলে যাওয়া উচিত ছিল।” রজতাভর দাদু বললেন।
রজতাভ বলল, “আমি ওর বাড়িতে যাব এখনি।”
“কেন দাদুভাই? এখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। কালকে সকালে গেলেই ভালো হতো না?”
“না। এখনই যাব, আর আমি একাই যাব।”
“বাড়ির সকলে বলে উঠল, “কী?”
“হ্যাঁ, আমি একাই।”
এরপর ভালোবাসার টানে ব্যাকুল হয়ে রজতাভ পাশের সবগুলি গ্রাম খুঁজতে শুরু করে। উমার পরিচয়পত্র বলতে তার কাছে উমার একটি ফটো ছিল। সেটাও রজতাভ অনেক অনুরোধ করার পর অষ্টমীর দিন সকালে উমার সাথে তুলেছিল। রাত ১১ টা পর্যন্ত প্রায় সমস্ত গ্রাম খুঁজেও রজতাভ উমার সন্ধান পেল না। ক্লান্ত শরীরে হতাশ হয়ে রাত ১২ টা নাগাদ সে বাড়িতে ফেরে এবং তখনই অনেক দূর থেকে ভেসে আসে একটা গান—
“ক্ষ্যাপা ছেড়ে দিলে সোনার গৌড়
আর পাবো না না… ছেড়ে দেবো না।
তোমায় হৃদ মাঝারে রাখবো ছেড়ে দেব না
তোমায় হৃদ মাঝারে রাখবো ছেড়ে দেবো না।”
নিজের অজান্তেই রজতাভর চোখের নিচে জলে ভরে গেল। এটি কি শুধুই গান নাকি রজতাভর বেদনাহত হৃদয়ের প্রতীক তা জানে না রজতাভ।
গল্পটি লিখেছে শিক্ষালয়ের ছাত্র, এবারের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীঃ
Anirban Sarkar
শিক্ষালয় ওয়েবসাইটের বিবিধ বিভাগে লেখা পাঠাতে যোগাযোগ করুন শিক্ষালয়ের What’s app নম্বরেঃ
শিক্ষালয় ওয়েবসাইটের সকল প্রকার আপডেট নিয়মিত লাভ করতে নিম্নের ফর্মটি যথাযথভাবে পূরণ করতে হবেঃ
- পঞ্চম শ্রেণি বাংলা সাজেশন
- ষষ্ঠ শ্রেণি বাংলা সাজেশন
- সপ্তম শ্রেণি বাংলা সাজেশন
- অষ্টম শ্রেণি বাংলা সাজেশন
- নবম শ্রেণি বাংলা সাজেশন
- দশম শ্রেণি বাংলা সাজেশন
- একাদশ শ্রেণি বাংলা সাজেশন
- দ্বাদশ শ্রেণি বাংলা সাজেশন