শিক্ষালয় ওয়েবসাইটের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের জন্য বাংলার ঋতু বৈচিত্র প্রবন্ধ প্রদান করা হলো। আশাকরি প্রবন্ধটি শিক্ষার্থীদের সহায়ক হয়ে উঠবে।
ভূমিকাঃ
মানবসভ্যতা যতই আধুনিকতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, মানুষের জীবনে ততোই প্রকট হচ্ছে অশান্তির কালো মেঘ। জীবনের অশান্তির এই নিকষ কালো অন্ধকারে সুখের চেয়ে মানুষ আজ স্বস্তির ব্যাকুল অনুসন্ধানী। আমাদের প্রিয় প্রকৃতিতেই রয়েছে সেই আকাঙ্ক্ষিত অনাবিল শান্তি ও স্বস্তির উপকরণ। সেজন্য এই আধুনিক যান্ত্রিক জীবনে মানুষ মুক্ত প্রকৃতির রূপ ও বৈচিত্র্য আস্বাদের জন্য ব্যাকুল। প্রকৃতির বৈচিত্র্য জীবনকে করে তোলে বর্ণময়, আর রূপ জীবনের একঘেয়েমি দূর করে নতুন রঙে রাঙিয়ে দেয়। বাঙালির সৌভাগ্য যে, আমাদের স্বদেশ বঙ্গভূমিতে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের কোনো অভাব নেই। বছরের বারো মাসে ছয় ঋতুতে প্রকৃতির নতুন রূপে নতুন লীলা বাংলার মানুষের জীবনকে অনাবিল স্নিগ্ধ আনন্দে ভরিয়ে তোলে। বঙ্গভূমির প্রকৃতি প্রত্যেকটি ঋতুতে বাঙালির জীবনে এনে দেয় নব নব রূপ ও রসের অপরূপ ছন্দ। বাংলার এই অপরূপ রূপে মোহিত হয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কলম থেকে নিঃসৃত হয়েছিল-
“জগতের মাঝে কত বিচিত্র তুমি হে – তুমি বিচিত্ররূপিনী”
বাংলার ঋতু বৈচিত্র্যঃ
বাংলায় প্রকৃতি সমগ্র বছরজুড়ে নানা ঋতুর সমাহারে বৈচিত্রের মধ্যে এক সার্বিক ঐক্য স্থাপন করে। প্রকৃতি বিশেষজ্ঞগণ প্রতিটি বছরকে প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে মোট ছয়টি ঋতুতে ভাগ করেছেন। প্রত্যেক ঋতু নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যে স্বতন্ত্র ও সমুজ্জ্বল। বছরের বারো মাসে প্রত্যেক দু মাস অন্তর এক একটি নতুন ঋতু জীর্ণ পুরাতনের অবসানে তার নতুন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে বাঙালির জীবনকে নানা বর্ণের ছটায় রাঙিয়ে দিয়ে যায়। সেই ছটায় প্রত্যেক বাঙালির জীবনে দুঃখ, কষ্ট, মন খারাপ, একঘেয়েমি দূর হয়ে আসে অনাবিল আনন্দের স্রোত। যদিও বর্তমানে প্রাকৃতিক দূষণ, গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর মত বিভিন্ন কারণে আর বাংলায় ছয়টি ঋতুর আবির্ভাব স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয় না। বদলে আমরা কেবলমাত্র গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ এবং শীত এই চারটি ঋতু অবস্থিতিকেই অনুভব করতে পারি। তবে বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামের ঋতু বৈচিত্রের উপর সভ্যতার এই আগ্রাসন এখনো সেভাবে থাবা বসাতে পারেনি।
গ্রীষ্মকালঃ
“প্রখর তপন তাপে, আকাশ তৃষায় কাঁপে, বায়ু করে হাহাকার”
ঋতু-পরিক্রমার প্রথম ঋতু গ্রীষ্মকাল। গ্রীষ্ম হল ‘রুদ্র তাপস। রুক্ষ তার তনু। উড্ডীন পিঙ্গল জটাজাল।’ তৃতীয় নেত্রে অগ্নিস্রাবি দৃষ্টি। তার ‘লোলুপ চিতাগ্নি শিখায়’ আকাশ বাতাস মাটি হয় দগ্ধ। সূর্যের প্রখর তাপে প্রচণ্ড দাবদাহে বাংলার মাটি, খাল, বিল, নদী-নালা শুষ্ক হয়ে পরম তৃষ্ণায় সামান্য বর্ষার প্রতীক্ষা করতে থাকে। তবে এমন রুদ্র রূপ এর মধ্যেও প্রকৃতি গ্রীষ্মের ডালি ভরে দেয় চম্পক, রজনীগন্ধা সহ আম, জাম, কাঁঠালের মতো নানা সরেস ফল ফুল দিয়ে। অবশেষে প্রখর রুদ্র মূর্তিতে বর্ষার আবাহন করে জ্যৈষ্ঠের শেষে এর অবসান ঘটে।
বর্ষাকালঃ
গ্রীষ্মের অবসানে হাজির হয় ‘ঘন গৌরবে নবযৌবন বরষা।’ বর্ষা হল ঋতু-পরিক্রমার দ্বিতীয় ঋতু। রুদ্র তাপস গ্রীষ্মের রুক্ষ অগ্নিস্রাবি দৃষ্টি আর প্রখর দাবদাহে শুষ্ক প্রকৃতি যখন পরম তৃষ্ণায় কাতর, তখনই মেঘের দামামা বাজিয়ে আকাশ কালো করে ধরিত্রীর বুকে নেমে আসে অঝোর বর্ষণ। এই অঝোর বৃষ্টি ধারায় ভরে যায় খাল বিল,নদী, নালা। এই সময়ে প্রকৃতি আবার নব কলেবরে সজ্জিত হয়ে ওঠে। ফুটিফাটা মাটি, খাল-বিল, নদী-নালা, পশুপাখি সকলে প্রশান্তিময় শীতলতায় স্বস্তি ফিরে পায়। গ্রাম বাংলার বুকে কৃষকের মন নেচে ওঠে আনন্দে। জমিতে বীজ তোলা ও রোপণের ধুম পড়ে।
শরৎকালঃ
“শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলী”
দুইমাস ব্যাপী বর্ষার অবসানে জল থৈ থৈ স্নিগ্ধ শীতল প্রকৃতির বুকে তৃতীয় ঋতু শরতের একটা আলাদা মাধুর্য ও বৈচিত্র্য রয়েছে। ঘনকালো মেঘে জমে থাকা বর্ষণের বাষ্প পৃথিবীর বুকে অঝোর ধারায় ঢেলে দিয়ে এসময় আকাশ হয়ে ওঠে ঘননীল। পেঁজা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ আকাশের বুকে ইতঃস্তত বিক্ষিপ্ত ভেসে বেড়ায়। তারা অতি স্নিগ্ধ, প্রশান্ত; যেন আর তাদের কোন তাড়া নেই। মাঠে মাঠে প্রস্ফুটিত কাশগুচ্ছ প্রকৃতির সাজসজ্জায় এক অনন্য মাত্রা এনে দেয়। এমন স্নিগ্ধ, শীতল প্রকৃতির বুকে জীবনের একঘেয়েমি দূর করে বাঙালি মেতে ওঠে পুজা পার্বনে। বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবগুলি এসময় পালিত হয়ে থাকে, যার মধ্যে অন্যতম হলো দুর্গোৎসব।
হেমন্তঃ
“হায় হেমন্ত লক্ষী, তোমার নয়ন কেন ঢাকা-
হিমেল ঘন ঘোমটাখানি ধূমল রঙে আঁকা।”
কুয়াশার ঘোমটা টেনে বিষাদখিন্ন হৃদয়ে বৈরাগ্যের তপস্যায় বাংলার চতুর্থ ঋতু হেমন্ত থাকে নীরব। হেমন্ত যেন বাংলার একান্ত নিজস্ব সম্পদ। কারণ অন্য কোথাও এর উপস্থিতি তেমন লক্ষ্য করা যায় না। এই হেমন্তেরই অগ্রহায়ণ মাসে আসে বাঙালির চির আকাঙ্খিত নবান্ন উৎসব। এসময় ধান কাটা শেষ হয়ে শুরু হয়; হয় চৈতালি ফসলের আয়োজন। শুকনো বাতাসে থাকে এক মন্থরতা। কার্তিক এবং অগ্রহায়ণ এই দুই মাস ধরে হেমন্ত ঋতুর ব্যাপ্তি। এই দুই মাসে প্রকৃতি ধীরে ধীরে স্নিগ্ধ শীতল থেকে আরো শীতলতর হতে থাকে। অবশেষে প্রকৃতিকে ঘাসের ওপর হীরের মতন চিকচিকে শিশির উপহার দিয়ে হেমন্ত বিদায় নেয়।
শীতকালঃ
“কার্তিকের এই ধানের খেতে
ভিজে হাওয়া উঠল মেতে
সবুজ ঢেউ’ইয়ের পরে।
পরশ লেগে দিশে দিশে
হি হি করে ধানের শিষে
শীতের কাঁপন ধরে।”
শিশির শয্যায় হেমন্তের অবসানে আসে শীত। শীতকালে পদে পদে জড়িয়ে থাকে শীতাতুর জড়তা। তবুও শীত বাঙালির উৎসবের; অত্যন্ত কাছের প্রিয় এক ঋতু। এই সময়ে বাঙালি মেতে ওঠে নানা ধরনের মিলন মেলায়। বাজারে আসে নতুন নতুন ফল ও সবজি। প্রকৃতির গাছপালা নিজের জীর্ণ পুরাতনকে ঝরিয়ে ফেলে নতুন রূপে সেজে ওঠার জন্য প্রস্তুত হয়।
বসন্তঃ
“বসন্ত তার গান লিখে যায় ধূলির ‘পরে কী আদরে।
তাই সে ধূলা ওঠে হেসে বারে বারে নবীন বেশে,
বারে বারে রূপ্রের সাজি আপনি ভরে কী আদরে।।”
সকল ঋতুর অবসানে বছরের অন্তিম লগ্নে আগমন ঘটে বসন্তের। এর উজ্জ্বল আলোর ধারায় চারিদিক হয় উদ্ভাসিত। শীতে ঝরে যাওয়া জীর্ণ প্রকৃতি নবকলেবর সেজে ওঠে। গাছপালাতে লাগে নতুন সবুজের ছোঁয়া। প্রস্ফুটিত শিমুল পলাশের অর্ঘ্যে আগমন ঘটে বাগদেবী সরস্বতীর। বাঙ্গালী গৃহবাসী দ্বার খুলে মেতে ওঠে নতুন রঙের খেলায়। আর কোকিলের কুহুতান এই অনাবিল আনন্দে এক নতুন মাত্রা যোগ করে দেয়।
উপসংহারঃ
বাংলার ঋতু পরিক্রমা কেবল প্রকৃতির রূপ পরিবর্তনের ধরাবাঁধা পটচিত্র মাত্র নয়। বাংলার ঋতুচক্র বাঙালির চেতনাকে মায়াময় কবিত্বে ভরে দিয়ে যায়। প্রকৃতির এই ঋতুচক্রে বাঙালির জীবন সুখ দুঃখে মিলেমিশে আবর্তিত হয়। ঋতুচক্রের কারণে যেমন প্রকৃতি নতুন নতুন সাজে সজ্জিত হয় তেমন কখনও অনাবৃষ্টির কারণ খরা বা কখনো অতিবর্ষনে বন্যাও হয়ে থাকে। বছরজুড়ে বৈচিত্র্যময় আবর্তনে এই ঋতুচক্র আমাদের যেন দুঃখকে জয় করে সুখের প্রতিষ্ঠার মূলমন্ত্রই শিখিয়ে দিয়ে যায়। আমাদের মন যেনো গেয়ে ওঠে-
“মোরে আরো আরো দাও প্রাণ।”
বাংলা ব্যাকরণ থেকে আলোচনা দেখতে এই লিঙ্কে ক্লিক/টাচ করতে হবে
বাংলা বিষয়ের অধ্যায়ভিত্তিক MCQ প্রশ্নের মক টেষ্ট প্রদান করতে এই লিঙ্কে ক্লিক/টাচ করতে হবে