অসুখী একজন- পাবলো নেরুদা
আমি তাকে ছেড়ে দিলাম
অপেক্ষায় দাঁড় করিয়ে রেখে দরজায়
আমি চলে গেলাম দূর… দূরে।
সে জানত না আমি আর কখনো ফিরে আসব না।
একটা কুকুর চলে গেল, হেঁটে গেল গির্জার এক নান
একটা সপ্তাহ আর একটা বছর কেটে গেল ।
বৃষ্টিতে ধুয়ে দিল আমার পায়ের দাগ
ঘাস জন্মালো রাস্তায়
আর একটার পর একটা, পাথরের মতো
পর পর পাথরের মতো, বছরগুলো
নেমে এল তার মাথার ওপর।
তারপর যুদ্ধ এল
রক্তের এক আগ্নেয়পাহাড়ের মতো।
শিশু আর বাড়িরা খুন হলো।
সেই মেয়েটির মৃত্যু হলো না।
সমস্ত সমতলে ধরে গেল আগুন
শান্ত হলুদ দেবতারা
যারা হাজার বছর ধরে
ডুবে ছিল ধ্যানে
উল্টে পড়ল মন্দির থেকে টুকরো টুকরো হয়ে
তারা আর স্বপ্ন দেখতে পারল না।
সেই মিষ্টি বাড়ি, সেই বারান্দা
যেখানে আমি ঝুলন্ত বিছানায় ঘুমিয়েছিলাম,
গোলাপি গাছ, ছড়ানো করতলের মতো পাতা
চিমনি, প্রাচীন জলতরঙ্গ
সব চূর্ণ হয়ে গেল, জ্বলে গেল আগুনে।
যেখানে ছিল শহর
সেখানে ছড়িয়ে রইল কাঠকয়লা
দোমড়ানো লোহা, মৃত পাথরের মূর্তির বীভৎস
মাথা
রক্তের একটা কালো দাগ।
আর সেই মেয়েটি আমার অপেক্ষায়।
“অসুখী একজন” কবিতা থেকে এখানে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নোট প্রদান করা হলো। শিক্ষার্থীরা নির্দিষ্ট নোটে টাচ/ক্লিক করে সেই বিষয়ের নোটগুলি দেখতে পারবে।
কবিতার উৎসঃ
চিলির কবি “পাবলো নেরুদা”-র স্প্যানিশ ভাষায় রচিত “Extravagaria” কাব্যগ্রন্থের ‘La Desdichada’ কবিতাটি ইংরেজিতে অনুদিত হয় ‘The Deseribed’ নামে। সাহিত্যিক “নবারুন ভট্টাচার্য” তাঁর “বিদেশি ফুলে রক্তের ছিটে” কাব্যগ্রন্থে কবিতাটি “অসুখী একজন” নামে অনুবাদ করেছেন।
কবিতার বিষয়সংক্ষেপঃ
চিলি দেশের গৃহযুদ্ধের পটভূমিতে কবি তাঁর এই কবিতাটি রচনা করেছেন। কবিতায় কথক তার প্রিয়তমাকে অপেক্ষায় দাঁড় করিয়ে রেখে দূরে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। কথকের অবর্তমানে অসহায় মেয়েটির জীবনে বছরগুলি নেমে এসেছিল পাথরের ন্যায়। যুদ্ধের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাঝে শিশু আর বাড়িরা খুন হলো, সমগ্র সমতলে আগুণ ধরে গেলো, আর ধ্বংস হয়ে গেলো কথকের স্মৃতিবিজরিত গোলাপি গাছ ও ঝুলন্ত বিছানা। অর্থাৎ যুদ্ধ মানুষের আশ্রয়, দেববিশ্বাস এবং আগামী প্রজন্মকে ধ্বংস করে দেয়। যুদ্ধের ফলে শুধুমাত্র রক্তপাত ও ধ্বংসলীলাই সাধিত হয়। যুদ্ধের বিরুদ্ধে, সকল প্রকার প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে স্বদেশ তথা মানবতার প্রতীক কথকের প্রিয়তমা সেই নারী। অহিংসা ও ভালোবাসাময় এক পৃথিবীর জন্য তার অপেক্ষার মধ্য দিয়েই কবি ঘোষণা করেছেন মানবতার জয়গান।
কবিতা থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ MCQ প্রশ্নের উত্তরঃ
১) কথক বিদায় নেওয়ার পর কয়টি সপ্তাহ/বছর কাটার কথা বলা হয়েছে- একটি
২) “সে জানতাে না”-সে জানতাে না- কথক আর কখনাে ফিরে আসবেন না
৩) “বৃষ্টিতে ধুয়ে দিল” বৃষ্টি ধুয়ে দিয়েছিল- কথকের পায়ের দাগ
৪) অপেক্ষারতা মেয়েটির মাথার উপর বছরগুলাে নেমে এসেছিল- পর পর পাথরের মতাে
৫) শান্ত হলুদ দেবতারা ধ্যানে ডুবে ছিল- হাজার বছর
৬) মিষ্টি বাড়িটির যেখানে ঝুলন্ত বিছানাটি ছিল- বারান্দায়
৭) কথক বিদায় নেওয়ার সময় অপেক্ষারতা মেয়েটি দাঁড়িয়েছিল- দরজায়
৮) অসুখী একজন কবিতায় দেবতাদের বিশেষণ দেওয়া হয়েছে- শান্ত হলুদ
৯) তারপর যুদ্ধ এলাে’-যুদ্ধ এসেছিল- রক্তের এক আগ্নেয় পাহাড়ের মতাে
১০) ‘অসুখী একজন’ কবিতায় মৃত্যু হয়নি- মেয়েটির
১১) ‘অসুখী একজন’ কবিতায় যে কালাে দাগটির কথা বলা হয়েছে তা হলাে- রক্তের
১২) ‘অসুখী একজন’ কবিতায় উল্লেখিত বীভৎস মাথাগুলি ছিল- মৃত পাথরের মূর্তির
১৩) একটা সপ্তাহ আর কেটে গেল, আর- একটা বছর
১৪) যেখানে ছিল শহর সেখানে ছড়িয়ে রইল- কাঠ কয়লা
কবিতা থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু SAQ প্রশ্নের উত্তরঃ
১) “আমি তাকে ছেড়ে দিলাম ” – আমি কে? এখানে কাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে?
উত্তরঃ চিলিয়ান কবি “পাবলো নেরুদা” রচিত “অসুখী একজন” কবিতায় ‘আমি’ হলেন এই কবিতার কথক। এখানে কথকের প্রেমিকা বা তাঁর ভালোবাসার মানুষটিকে তাঁর অপেক্ষায় দরজার দাড় করিয়ে রাখার কথা বলা হয়েছে।
২) কার অপেক্ষায় কে, কোথায় দাড়িয়েছিলেন?
উত্তরঃ চিলিয়ান কবি “পাবলো নেরুদা” রচিত “অসুখী একজন” কবিতায় কথকের অপেক্ষায় তাঁর প্রেমিকা বা তার ভালোবাসার মানুষটি অপেক্ষায় দরজার দাড়িয়ে ছিলেন।
৩) “সে জানত না “- এখানে কার কী না জানার কথা বলা হয়েছে?
উত্তরঃ চিলিয়ান কবি “পাবলো নেরুদা” রচিত “অসুখী একজন” কবিতায় কথকের আর কখনোই ফিরে না আসার কথাটিকে বোঝানো হয়েছে।
৪) ‘অসুখী একজন’ কবিতায় দেবতারা কত বছর ধ্যানে ডুবে ছিলেন?
উত্তরঃ চিলিয়ান কবি “পাবলো নেরুদা” রচিত “অসুখী একজন” কবিতায় দেবতারা হাজার বছর ধ্যানে ডুবে ছিলেন বলে জানা যায়।
৫) অসুখী একজন কবিতায় কিসের মাধ্যমে কবির পায়ের দাগ ধুয়ে গিয়েছিল?
উত্তরঃ চিলিয়ান কবি “পাবলো নেরুদা” রচিত “অসুখী একজন” কবিতায় বৃষ্টির জলের মাধ্যমে কথকের পায়ের দাগ ধুয়ে গিয়েছিল।
৬) অসুখী একজন কবিতায় কার মাথায় কী নেমে এসেছিল?
উত্তরঃ চিলিয়ান কবি “পাবলো নেরুদা” রচিত “অসুখী একজন” কবিতায় কথকের প্রিয়তমার মাথায় পাথরেরে মতো কঠিনতা নিয়ে সময় বা বছরগুলো নেমে এসেছিল।
৭) “শিশু আর বাড়িরা খুন হলো”- শিশু আর বাড়িরা খুন হয়েছিল কেন?
উত্তরঃ চিলিয়ান কবি “পাবলো নেরুদা” রচিত “অসুখী একজন” কবিতায় যে যুদ্ধের কথা জানা যায়, তার বীভৎসতা এবং নৃশংসতায় শিশু এবং বাড়িরা খুন হয়েছিল।
৮) যেখানে শহর ছিল, সেখানে যুদ্ধের পর কী ছড়িয়ে ছিল?
উত্তরঃ চিলিয়ান কবি “পাবলো নেরুদা” রচিত “অসুখী একজন” কবিতায় জানা যায় যে, যেখানে শহর ছিল, সেখানে যুদ্ধের পর কাঠকয়লা, দোমড়ানো লোহা, মৃত পাথরের মূর্তির বীভৎস মাথা, মানুষের কালো রক্তের দাগ ছড়িয়ে ছিল।
৯) অসুখী একজন কবিতায় যুদ্ধের পরে সেই মেয়েটির কী হয়েছিল?
উত্তরঃ চিলিয়ান কবি “পাবলো নেরুদা” রচিত “অসুখী একজন” কবিতায় যুদ্ধের পরেও সেই মেয়েটি অর্থাৎ কথকের প্রিয়তমা বেঁচেছিলেন।
১০) দেবতাদের জন্য কবিতায় কোন বিশেষণ ব্যবহৃত হয়েছে?
উত্তরঃ চিলিয়ান কবি “পাবলো নেরুদা” রচিত “অসুখী একজন” কবিতায় দেবতাদের শান্ত ও হলুদ বিশেষণে বিশেষায়িত করা হয়েছে।
শিক্ষালয় ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বাংলা ব্যাকরণের নোটগুলি দেখতে এই লিঙ্কে ক্লিক/টাচ করতে হবে
বড়ো প্রশ্নের উত্তরঃ
১) ‘অসুখী একজন’ কবিতাটিকে ‘যুদ্ধবিরোধী কবিতা’ বলা যায় কিনা- আলোচনা করো। ৫
উৎসঃ
চিলির কবি “পাবলো নেরুদা”-র স্প্যানিশ ভাষায় রচিত “Extravagaria” কাব্যগ্রন্থের ‘La Desdichada’ কবিতাটি ইংরেজিতে অনুদিত হয় ‘The Deseribed’ নামে। সাহিত্যিক “নবারুন ভট্টাচার্য” তাঁর “বিদেশি ফুলে রক্তের ছিটে” কাব্যগ্রন্থে কবিতাটি “অসুখী একজন” নামে অনুবাদ করেছেন।
ভূমিকাঃ
শুভবুদ্ধিসম্পন্ন অহিংস সাধারণ মানুষ কখনোই যুদ্ধ চায় না। কিন্তু ক্ষমতালোভী স্বার্থপর মানুষেরা নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থকে চরিতার্থ করতে দেশে দেশে যুদ্ধের ভয়াবহতার সৃষ্টি করে।
চিলি দেশের গৃহযুদ্ধের পটভূমিতে কবি তাঁর এই কবিতাটি রচনা করেছেন। কবিতায় কথক তার প্রিয়তমাকে অপেক্ষায় দাঁড় করিয়ে রেখে দূরে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন-
“আমি তাকে ছেড়ে দিলাম
অপেক্ষায় দাঁড় করিয়ে রেখে দরজায়
আমি চলে গেলাম দূর… দূরে।”
যুদ্ধ ও তার ফলশ্রুতিঃ
কথকের অবর্তমানে অসহায় মেয়েটির জীবনে বছরগুলি নেমে এসেছিল পাথরের ন্যায়। কিন্তু-
“তারপর যুদ্ধ এল
রক্তের আগ্নেয়পাহাড়ের মতো।”
যুদ্ধের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাঝে শিশু আর বাড়িরা খুন হলো, সমগ্র সমতলে আগুণ ধরে গেলো, আর ধ্বংস হয়ে গেলো কথকের স্মৃতিবিজরিত গোলাপি গাছ ও ঝুলন্ত বিছানা। অর্থাৎ যুদ্ধ মানুষের আশ্রয়, দেববিশ্বাস এবং আগামী প্রজন্মকে ধ্বংস করে দেয়। যুদ্ধের ফলে শুধুমাত্র রক্তপাত ও ধ্বংসলীলাই সাধিত হয়।
যুদ্ধ বিরোধিতাঃ
“যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই”– এই বার্তাই যেন কবি প্রচ্ছন্নভাবে তাঁর এই কবিতায় ব্যক্ত করেছেন। তাই যুদ্ধের বিরুদ্ধে, সকল প্রকার প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে স্বদেশ তথা মানবতার প্রতীক কথকের প্রিয়তমা সেই নারী। অহিংসা ও ভালোবাসাময় এক পৃথিবীর জন্য তার অপেক্ষার মধ্য দিয়েই কবি ঘোষণা করেছেন মানবতার জয়গান-
“আর সেই মেয়েটি আমার অপেক্ষায়”
অর্থাৎ আলোচনার পরিশেষে আমরা দৃপ্ত কন্ঠে বলতে পারি, যুদ্ধের নেতিবাচক ভাবের বিরুদ্ধে মানবিক আবেদনকেই কবি অধিক গুরত্ব প্রদান করেছেন। তাই তাঁর কবিতাটি হয়ে উঠেছে একটি যুদ্ধবিরোধী কবিতা।
‘অসুখী একজন’ কবিতার নামকরণের সার্থকতা বিচার করো।
Good
ধন্যবাদ। শিক্ষালয়ের শিক্ষাজগতে স্বাগত।