আড্ডা ।। পঞ্চতন্ত্র ।। সৈয়দ মুজতবা আলি ।। একাদশ শ্রেণি বাংলা

আড্ডা ।। পঞ্চতন্ত্র ।। সৈয়দ মুজতবা আলি ।। একাদশ শ্রেণি বাংলা

একাদশ শ্রেণি বাংলা সেমিষ্টার ২ এর অন্তর্গত একাদশ শ্রেণি বাংলা পঞ্চতন্ত্র পূর্ণাঙ্গ সহায়ক গ্রন্থের আড্ডা ।। পঞ্চতন্ত্র ।। সৈয়দ মুজতবা আলি ।। একাদশ শ্রেণি বাংলা প্রদান করা হলো। একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা তাদের সেমিষ্টার ২ এর জন্য নিম্নে প্রদান করা আড্ডা ।। পঞ্চতন্ত্র ।। সৈয়দ মুজতবা আলি ।। একাদশ শ্রেণি বাংলা পাঠ করতে পারবে এবং তাদের প্রশ্নের উত্তর দেখতে পারবে। 

শিক্ষালয় ওয়েবসাইটের সকল প্রকার আপডেট লাভ করতে মোবাইল স্ক্রিনের বা’দিকের নিম্নের অংশে থাকা বেল আইকনটিতে (🔔) টাচ করে শিক্ষালয় ওয়েবসাইটের নোটিফিকেশন অন করে রাখুন।

আড্ডা ।। পঞ্চতন্ত্র ।। সৈয়দ মুজতবা আলি ।। একাদশ শ্রেণি বাংলাঃ 

আড্ডা সম্বন্ধে সম্প্রতি কয়েকটি উত্তম উত্তম লেখা বাঙলায় বেরনোর পর ইংরিজিতেও দেখলুম। আড্ডা হামলা চালিয়েছে। চণ্ডীমণ্ডপের ভশচায এবং জমিদার-হাবেলির মৌলবী যেন হঠাৎ কোট-পাতলুন-কামিজ পরে গটগট করে স্টেটসম্যান অফিসে ঢুকলেন। আমার তাতে আনন্দই হল।

কিন্তু এ সম্পর্কে একটি বিষয়ে আড়ডার কিঞ্চিৎ বক্তব্য আছে! আড্ডাবাজরা বলতে চান, বাংলার বাইরে নাকি আড্ডা নেই। কথাটা ঠিকও, ভুলও। তুলনা দিয়ে নিবেদন করছি। সিন্ধুনদ উজিয়ে যে মাছ ধরা পড়ে, তার নাম ‘পাল্লা’—অতি উপাদেয় মৎস্য। নর্মদা, উজিয়ে ভরোচ শহরে যে মাছ ধরা পড়ে তার নাম ‘মাদার’—সেও উপাদেয় মৎস্য। আর গঙ্গা পদ্মা উজিয়ে যে মাছ বাঙালিকে আকুল উতলা করে তোলে, তার নাম ইলিশ-খোট্টা (মাফ কীজীয়ে) মুলুকে পৌঁছনর পর তার নাম হয় হিল্‌সা।

উপযুক্ত সর্ব মৎস্য একই বস্তু–দেশভেদে ভিন্ন নাম। তফাৎ মাত্র এইটুকু যে সরষে বাটা আর ফালি ফালি কাঁচা লঙ্কা দিয়ে আমরা যে রকম ইলিশ দেবীর পুজো দি, বাদবাকিরা ওরকম ধারা পারে না। অর্থাৎ আড্ডা বহু দেশেই আছে, শুধু আমাদের মত তরিবৎ করে রাসিয়ে রসিয়ে চাখতে তারা জানে না। অপিচ ভুললে চলবে না সিন্ধীরা আমাদের সরষেইলিশ খেয়ে নাক সিটিকে বলেন, ‘কী উমদা চীজকে বরবাদ করে দিলে।’ ভূগুকচ্ছের (ভরোচের) মহাজনগণও সিন্ধীর রান্না পাল্লা খেয়ে ‘আল্লা আল্লা’ বলে রোদন করেন।

কে সূক্ষ্ম নিরপেক্ষ বিচার করবে? এ যে রসবস্তু—এবং আমার মতে ভোজনরস সৰ্বরসের রসরাজ।

তাই কইরের আড্ডাবাজরা বলেন, একমাত্র তারা নাকি আড্ডা দিতে জানেন।

কাইরোর আড্ডা ককখনো কোনো অবস্থাতেই কারো বাড়িতে বসে না। আড্ডাবাজরা বলেন তাতে করে আড্ডা নিরপেক্ষতা-কিংবা বলুন গণতন্ত্র-লোপ পায়। কারণ যার বাড়িতে আড্ডা বসলো, তিনি পানটা-আসাটা, খিচুড়িটা, ইলিশ-ভাজটা (আবার ইলিশ! সুশীল পাঠক, ক্ষমা করো। ঐ বস্তুটির প্রতি আমার মারাত্মক দুর্বলতা আছে। বেহেশতের বর্ণনাতে ইলিশের উল্লেখ নেই বলে পাঁচ-বকৎ নামাজ পড়ে সেথায় যাবার কণামাত্র বাসনা আমার নেই)। ফিরি’ দেন বলে তঁকে সবাই যেন একটু বেশি তোয়াজ করে। আড্ডাগোত্রের মিশরী নিকষ্যি মহাশয়রা বলেন, বাড়ির আড্ডায় ‘মেল’ মেলে না।

অপিচ, পশ্য পশ্য, কোনো কাফেতে যদি আড্ডা বসে, তবে সেখানে কেউ কাউকে খয়ের খাঁ বানাতে পারে না—যেন পুরীর মন্দির, জাতফাত নেই, সব ভাই, সব বেরাদর।

এবং সব চেয়ে বড় কথা বাড়ির গিন্নি মুখপোড়া মিনিষেরা ওঠে না কেন’ কখনো শুনিয়ে, কখনো আভাসে ইঙ্গিতে জানিয়ে অকারণে অকালে আড্ডার গলায় ছুরি চালাতে পারেন না। তার চেয়ে দেখো দিকিনি, দিব্যি কাফেতে বসে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিচ্ছ, পছন্দমাফিক মমলেট কটলেট খাচ্ছো, আড্ডা জমজমাট ভরভরাট, কেউ বাড়ি যাবার নামটি করছে না, কারো গিন্নি এসে উপস্থিত হবেন সে ভয়ও নেই-আর চাই কি?

শতকরা নব্বই জন কাইরোবাসী আডাবাজ এবং তার দশ আনা পরিমাণ অর্ধেক জীবন কাটায় কাফেতে বসে আড্ডা মেরে। আমাদের আড্ডা বসত ‘কাফে দ্য নীল’ বা ‘নীলনদ ক্যাফেতে’। কফির দাম ছাঁ। পয়সা ফি পাত্তর। রাবাড়ির মত ঘন, কিন্তু দুধ চাইলেই চিত্তির। সবাই কালো কফি খায়, তাই দুধের কোনো ব্যবস্থা নেই। কিচ্ছ। ঘাবড়াবেন না, দুদিনেই অভ্যাস হয়ে যায়। কালো কফি খেলে রঙভী ফর্সা হয়।

আমাদের আড্ডাটা বসত কাফের উত্তর-পূর্ব কোণে, কাউন্টারের গা ঘেঁষে। হরেক জাতের চিড়িয়া সে আড্ডায় হরবকৎ মৌজুদ থাকত। রমজান বে। আর সজ্জাদ এফেন্দি খাঁটি মিশরী মুসলমান ওয়াহহাব আতিয়া কপ্টা ক্ৰীশচান অর্থাৎ ততোধিক খাঁটি মিশরী, কারণ তার শরীরে রয়েছে ফারাওদের রক্ত। জুর্নে ফরাসি কিন্তু ক’পুরুষ ধরে কাইরোর হাওয়া বিষাক্ত করছে। কেউ জানে না, অতি উত্তম আরবী কবিতা লেখে আর সে কবিতার আসল বক্তব্য হচ্ছে, সে তলওয়ার চালিয়ে আড়াই ডজন বেদুইনকে ঘায়েল করে প্রিয়াকে উটের উপর তুলে মরুভূমির দিগদিগন্ত বিলীন হয়ে যাচ্ছে, যদিও আমরা সবাই জানতুম, জুর্নো যেটুকু মরুভূমি দেখেছে সে পিরামিডে বেড়াতে গিয়ে, তাও জীবনে একবার মাত্র, যদিও পিরামিড কাইরো থেকে মাত্র পাঁচমাইল দূরে। উট কখনো চড়ে নি, ট্রামের ঝাকুনিতেই বমি করে ফেলে। আর তলওয়ার? তওবা, তওবা! মার্কোস জাতে গ্ৰীক, বেশি নয় কুল্লে আড়াই হাজার বৎসর ধরে তারা মিশরে আছে। মিশর রাণী, গ্ৰীক রমণী ক্লিয়োপাত্রার সঙ্গে তার নাকি খেশ-কুটুম্বিতা আছে। হবেও বা, কারণ প্রায়ই ব্যবসাতে দাঁও মেরেছে বলে ফালতো এবং ফিরি’ এক রোঁদ কফি খাইয়ে দিত। তাতে করে কাফের ‘গণতন্ত্র ক্ষুণ্ণ হত না, কারণ মার্কোসকে ‘কটা ফালাইলেও আড্ডার ঝগড়া কাজিয়ায় সে কস্মিনকালেও হিস্যা নিত না; বেশির ভাগ সময় চেয়ারের হেলানে মাথা রেখে আকাশের দিকে হাঁ করে ঘুমুতো কিংবা খবরের কাগজ থেকে তুলোর ফটক বাজারের তেজি-মন্দির (বুল এ্যান্ড বিয়ার) হালহকিকৎ মুখস্থ করতো।

আর বাঙলা দেশের তাবৎ চণ্ডীমণ্ডপ, বেবাক জমিদার-হাবেলীর আড্ডার প্রতিভূ হিসেবে আপনাদের আশীর্বাদে আর শ্ৰীগুরুর কৃপায় ধূলির ধূলি এ-অধম।

আমার বাড়ির নিতান্ত গা ঘেঁষে বলে নিছক কফি পানার্থে ঐ কাফেতে আমি রোজ সকাল-সন্ধ্যা যেতুম। বিদেশ-বিভুই, কাউকে বড় একটা চিনি নে, ছন্নের মত হেথা-হোথা ঘুরে বেড়াই আর দেশভ্রমণ যে কি রকম পীড়ামদায়ক ‘প্রতিষ্ঠান’ সে সম্বন্ধে একখানা প্রামাণিক কেতাব লিখব বলে মনে মনে পায়তারা কষি। এমন সময় হঠাৎ খেয়াল গোল কাফের কোণের আড্ডাটির দিকে। লক্ষ্য করি নি যে কফি-পানটা ওদের নিতান্ত গৌণকর্ম, ওরা আসলে আড্ডাবাজ।

আম্মো যে আডাবাজ সে তত্ত্বটা এদেরও মনে ঝিলিক দিয়ে গেল একই ব্রাহ্মমুহূর্তে। সে ‘মহালগনে’র বর্ণনা আমি আর কি দেব? সুরসিক পাঠক, তুমি নিশ্চয়ই জানো শ্ৰীহরি শ্ৰীরাধাতে, ইউসুফ জোলেখাতে, লায়লী মজনুতে, ত্রিস্তান ইজোলদেতে কি করে প্রথম চারি চক্ষু বিনিময় হয়েছিল। কী ব্যাকুলতা, কী গভীর তৃষা কী মহা ভবিষ্যতের প্রগাঢ় সুখস্বপ্ন, কী মরুতীর পার হয়ে সুধাশ্যামলিম নীলাম্বুজে অবগাহনানন্দ সে দৃষ্টি-বিনিময়ে ছিল। এক ফরাসি কবি বলেছেন, ‘প্রেমের সব চেয়ে মহান দিবস সেদিন, যেদিন প্রথম বলেছিলুম আমি তোমাকে ভালোবাসি।’ তত্ত্বটা হৃদয়ঙ্গম হয়। সেই ব্ৰাহ্মা মুহুর্তে।

তাবী-তুলসী-গঙ্গাজল নিয়ে আসুন, স্পর্শ করে বলব, তিন লহমাও লাগে নি, এই ব্রাত্যের উপনয়ন হয়ে গেল, বেদ শাখা ঋষি স্থির হয়ে গেলেন-সোজা বাঙলায় বলে, জাতে উঠে গেলুম। অমিয়া ছানিয়া, নয়ন হানিয়া বললুম, ‘এক রোঁদ কফি?’

আড্ডার মেম্বাররা অএকে অনেয়র দিকে তাকিয়ে পরিতোষের স্মিতহাস্য বিকশিত করলেন। ভাবখানা, ভুল লোককে বাছা হয় নি।

কাফের ছোকরাটা পর্যন্ত ব্যাপারটা বুঝে গিয়েছে। আমার ছন্নছাড়া ভাবটা তার চোখে বহু পূর্বেই ধরা পড়েছিল। রোঁদ পরিবেশন করার সময় নীলনদ-ডেল্টার মত মুখ হাঁ করে হেসে আমি যে অতিশয় ভদ্রলোক-অর্থাৎ জোর টিপস দি—সে কথাটা বলে আন্ডার সামনে আমার কেস রেকমেন্ড করলো।

জুর্নো তাড়া লাগিয়ে বললেন, ‘যা, যা ছোঁড়া, মেলা জ্যাঠামো করিস নে।’ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘খাসা আরবী বলেন আপনি।’

রবিঠাকুর বলেছেন—

‘এত বলি সিক্তপক্ষ্ম দুটি চক্ষু দিয়া
সমস্ত লাঞ্ছনা যেন লাইল মুছিয়া
বিদেশীর অঙ্গ হতে-’

ঠিক সেই ধরনে আমার দিকে তাকিয়ে জুনো যেন আমার প্রবাস-লাঞ্ছনা এক থাবড়ায় ঝেড়ে ফেললেন, আমার অঙ্গ থেকে।

আমি কিন্তু মনে মনে বললুম, ইয়া আল্লা, তেরো দিনের আরবীকে যদি এরা বলে খাসা তবে এরা নিশ্চয়ই খানদানী মনিষ্যি।’ করজোড়ে বললুম, ‘ভারতবর্ষের নীতি, সত্য বলবে, প্রিয় বলবে, অপ্ৰিয় সত্য বলবে না; আপনাদের নীতি দেখছি আরো এক কদম এগিয়ে গিয়েছে, প্রিয় অসত্যও বলবে।’

আড্ডা তো—পালিমেন্ট নয়—তাই হরবকৎ কথার পিঠে কথা চলবে এমন কোনো কসমদিব্যি নেই। দুম করে রমজান বে বললে, ‘আমার মামা (আমি মনে মনে বললুম, ‘যজ্ঞিদাসের মামা’) হজ করতে গিয়েছিলেন আর বছর। সেখানে জনকয়েক ভারতীয়ের সঙ্গে তার আলাপ হয়। তারা নাকি পাঁচ বকৎ নামাজ পড়ত আর বাদবাকি তামাম দিনরাত এক চায়ের দোকানে বসে কিচির-মিচির করত। তবে তারা নাকি কোন এক প্রদেশের—বিঙ্গালা, বাঙালি-কি যেন-আমার ঠিক মনে নেই।–’

উৎসাহে উত্তেজনায় ফেটে গিয়ে চৌচির হয়ে আমি শুধালুম, ‘বাঙালা?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ।’

আমি চোখ বন্ধ করে ভাবলুম, শ্ৰীরামকৃষ্ণদেব, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম বাঙালি। কিন্তু কই, কখনো তো এত গর্ব অনুভব করিনি যে, আমি বাঙালি। এই যে নমস্য মহাজনরা মক্কা শহরে আড্ডাবাজ হিসেবে নাম করতে পেরেছেন-নিশ্চয়ই বিশ্ৰী মাথার ঘাম পায়ে ফেলে—তারা আলবৎ শ্ৰীহট্ট, নোয়াখালি, চাটগা, কাছাড়ের বাঙালি খালাসী, পশ্চিমবঙ্গের কলিকাতা নগরীর উপকণ্ঠে খিদিরপুরে আড্ডা মারতে শিখে ‘হেলায় মক্কা করিলা জয়’!

আস্তে আস্তে চেয়ার থেকে উঠে ডান হাত বুকের উপর রেখে মাথা নিচু করে অতিশয় সবিনয় কণ্ঠে বললুম, ‘আমি বাঙালি।’

গ্ৰীক সদস্য মার্কোস প্রথম পরিচয়ের সময় একবার মাত্র ‘সালাম আলাইক’ করে। খবরের কাগজের পিছনে ডুব মেরেছিলেন। তাঁর কানে কিছু যাচ্ছিল কি না জানি নে। আমি ভাবলুম রাশভারী লোক, হয়তো ভাবছেন, নূতন মেম্বার হলেই তাঁকে নূতন জামাইয়ের মত কাঁধে তুলে ধেই ধেই করেই নাচতে হবে একথা আড্ডার কনসটিটুৰ্যশানে লেখে না। মুখের উপর থেকে খবরের কাগজ সরিয়ে বললেন, ‘দাঁও মেরেছি। একটা শ্যাম্পেন্ন হবে? আমাদের নূতন মেম্বার—।’ কাউন্টারের পিছনে দাঁড়িয়েছিল মালিক; তার দিকে তাকিয়ে বঁ হাত গোল করে বোতল ধরার মুদ্রা দেখিয়ে ডান হাত দিয়ে দেখালেন ফোয়ারার জল লাফানোর মুদ্রা। ম্যানেজার কুল্লে দুই ডিগ্ৰী কাৎ করে ঘাড় নাড়ল।

আমি ভয়ে ভয়ে বললুম, ‘এ দোকানে তো মদ বেচার লাইসেন্স নেই।’

মার্কোস বললেন, ‘কাফের পেছনে, তার ড্রইংরুমে। ব্যাটা সব বেচে;-আফিম, ককেইন, হেরোইন, হশীশ যা চাও।’

ছোকরাকে বললেন, ‘আর একটা তামাকও সাজিস।’

বলে কি? কাইরোতে তামাক! স্বপ্ন নু মায়া নুমতিভ্ৰম নু?

দিব্যি ফর্শী হাঁকো এল। তবে হনুমানের ন্যাজের মত সাড়ে তিনগজী দরবারি নল নয় আর সমস্ত জিনিসটার গঠন কেমন যেন ভোঁতা ভোঁতা। জরির কাজ করা আমাদের ফর্শী কেমন যেন একটু নাজুক’, মোলায়েম হয়-এদের যেন একটু গাইয়া। তবে হ্যাঁ, চিলিমটা দেখে ভক্তি হল-ইয়া ডাবর পরিমাণ। একপো তামাক হেসেখেলে তার ভিতর থানা গাড়তে পারে-তাওয়াও আছে। আগুনের বেলা অবিশ্যি আমি টিকের ধিকিধিক গোলাপী গরম প্রত্যাশা করি নি, কারণ কাবুলেও দেখেছি টিকে বানাবার গুহ্য তথ্য সেখানকার রসিকরাও জানেন না।

আর যা খুশবাই বেরল তার রেশ দীর্ঘ চৌদ্দ বছর পরও যেন আমার নাকে লেগে আছে।

পাঠক, তুমি নিশ্চয়ই জানো সুগন্ধী ইজিপশিয়ন সিগারেট ভুবনবিখ্যাত। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছি বিশেষ করে মিশরই সুগন্ধী সিগারেট তরিবৎ করে বানাতে শিখল কি করে? আইস সে সম্বন্ধে ঈষৎ গবেষণা করা যাক। এই সিগারেট বানানোর পিছনে বিস্তর ইতিহাস, এস্তার রাজনীতি এবং দেদার রসায়নশাস্ত্ৰ লুক্কায়িত রয়েছে।

সিগারেটের জন্য ভালো তামাক জন্মায় তিন দেশে। আমেরিকার ভার্জিনিয়াতে, গ্ৰীসের মেসেডোন অঞ্চলে এবং রুশের কৃষ্ণসাগরের পারে পারে। ভারতবর্ষ প্রধানত ভার্জিনিয়া খায়, কিছুটা গ্ৰীক, কিন্তু এই গ্ৰীক তামাক এদেশে টার্কিশ এবং ইজিপশিয়ান নামে প্রচলিত। তার কারণ একদা গ্ৰীসের উপর আধিপত্য করতে তুর্কী এবং তুর্কী গ্ৰীসের বেবাক। তামাক ইস্তাম্বুলে নিয়ে এসে কাগজে পেচিয়ে সিগারেট বানোত। মিশরও তখন তুর্কীর। কন্তুজাতে, তাই তুর্কীর কর্তারা কিছুটা তামাক মিশরে পাঠাতেন। মিশরের কারিগররা সেই গ্ৰীক তামাকের সঙ্গে খাঁটি মিশরের খুশবাই মাখিয়ে দিয়ে যে অনবদ্য রাসনলী নির্মাণ করলেন তারই নাম ইজিপশিয়ান সিগারেট।

নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন চায়ের টিন যদি রান্নাঘরে ভালো করে বন্ধ না রাখা হয়, তবে ফোড়নের বাঁঝে চা বরবাদ হয়ে যায়, অর্থাৎ কিছু না হোক খুশবাইটি আঁতুড়ঘরে নুনখাওয়ানো বাচ্চার মত প্ৰাণত্যাগ করে। মালজাহাজ লাদাই করা যে অফিসারের কর্ম তিনিও বিলক্ষণ জানেন, যে জাহাজে কাঁচা তামাক লাদাই করা হয়েছে তাতে কড়া গন্ধওলা অন্য কোনো মাল নেওয়া হয় না-পাছে তামাকের গন্ধ এবং কিঞ্চিৎ স্বাদও নষ্ট হয়ে যায়।

তাই তামাকের স্বাদ নষ্ট না করে সিগারেটকে খুশবাইয়ে মজানো অতীব কঠিন কর্ম। সিগারেটে একফোঁটা ইউকেলিপটাস তেল ঢেলে সেই সিগারেট ফুঁকে দেখুন, একফোঁটা তেল আস্ত সিগারেট একদম বরবাদ করে দিয়েছে। পাঁচ বছরের বাচ্চাও তখন সে সিগারেট না কেশে অনায়াসে ভস ভস করে ফুঁকে যেতে পারে (বস্তুত বড বেশি ভেজা সর্দি হলে অনেকে এই পদ্ধতিতে ইউকেলিপটাস সেবন করে থাকেন-যারা সিগারেট সইতে পারেন না তারা পর্যন্ত)।

বরঞ্চ এমন গুণী আছেন যিনি এটম বামের মাল-মসলা মেশানোর হাড়হদ্দ হালহকিকৎ জানেন, কিন্তু তামাকের সঙ্গে খুশবাই! তার পিছনে রয়েছে গূঢ়তর রহস্যাবৃত ইন্দ্ৰজাল।

কিচ্ছু বাড়িয়ে বলছি নে। অজন্তার দেওয়াল এবং ছবির রঙ কোন কোন মসলা দিয়ে বানানো হয়েছিল, পাঠানযুগে পাথরে পাথরে জোড়া দেবার জন্য কি মাল কোন পরিমাণে লাগানো হয়েছিল। আমরা সে তত্ত্বগুলো মাথা খুঁড়েও বের করতে পারি নি এবং পারে নি বিশ্বসংসার বের করতে কি কৌশলে, কি মসলা দিয়ে মিশনারীরা মমীগুলোকে পচার হাত থেকে বাঁচিয়েছিল।

স্বীকার করি, মিশরীরাই একদিন সে কায়দা ভুলে মেরে দিয়েছিল-পাঠান-মোগল যুগে যে রকম আমাদের অনেকখানি রসায়নবিদ্যা অনাদরে লোপ পায়। তবু তো আমরা আজও মকরধ্বজ, চ্যবনপ্রাশ বানাতে পারি-ভেজাল তো শুরু হল মাত্র সেদিন, আমাদেরই চশমার সামনে!

মিশরীরাও ঠিক সেইরকম সুগন্ধ তত্ত্ব সম্পূর্ণ ভুলে যায় নি। ঝড়তি-পড়তি যেটুকু এলেম তখনো তাদের পেটে ছিল তাই দিয়ে তারা সেই সমস্যা সমাধান করলো, তামাকে কি করে খুশবাই জোড়া যায়, তামাকের ‘সোয়াদটি জখম না করে।

তাই যখন কোনো ডাকসাইটে তামাক কদরদারের (হায়! এ গোত্র পৃথিবীর সর্বত্র কি কাবুল, কি দিল্লি, কি কাইরো-সুকুমারের ভাষায় বলি-হুশ হুশ করে মরে যাচ্ছে) তদারকিতে কাইরোর কাফেতে তামাক সাজা হয় এবং সেই কদরদার যখন সে তামাকের নীলাভ ধুঁয়োটি ফুরফুর করে নাকের ভিতর দিয়ে ছাড়েন এবং নীলনদের মন্দমধুর ঠাণ্ডা হাওয়া যখন সেই ধুঁয়োটির সঙ্গে রসকেলি করে তাকে ছিন্নভিন্ন করে কাফের সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়। তখন রাস্তার লোক পর্যন্ত উন্নাসিক হয়ে থমকে দাঁড়ায়, পাঁড় সিগারখেকো, পাইকারি সিগারেট ফোকা পর্যন্ত বুকের উপর হাত রেখে আসমানের দিকে তাকিয়ে অলহমদুলিল্লা’ (খুদাতালার তারিফ) বলে।

আর ইলিশের বেলা যে-রকম হয়েছিল, এ অধম ঠিক সেই রকম তাজ্জব মানে, বেহশতের বর্ণনায় এ তামাকের বয়ান নেই কেন? তা হলে পাপ করে নরকে যেত কোন মূর্খ?

বাঙালি তার চুলটিকে কেতাদুরস্ত করে রাখতে ভালোবাসে, কাবুলী বেলা-অবেলা মোক পেলেই তার পায়জারে গুটিকয়েক পেরেক ঠুকিয়ে নেয়, ইংরেজ আয়না সামনে পেলেই টাইটা ঠিক মধ্যিখানে আছে কিনা তার তদারকিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, পেশাওয়ারী পাঠানের প্রধান শিরঃপীড়া তার শিরাভরণ নিয়ে, আর মিশরীর চরম দুর্বলতা তার জুতো জোড়াটিকে ‘বালিশ’ (আরবী ভাষায় ‘প’ অক্ষর নেই, তাই ইংরিজি ‘পালিশ’ কথাটা মিশরীতে ‘বালিশ’ রূপে ধারণ করেছে) রাখার জন্যে।

অতএব কাফেতে ঢোকামাত্রই কাফের ‘বুৎ-বালিশ’ (অর্থাৎ বুট পালিশ করনেওলা) ছোকরা এসে আপনাকে সেলাম ঠুকবে। আপনি তাকে বিলক্ষণ চেনেন, তাই দীতমুখ খিচিয়ে বলবেন, যা, যা’–তার অর্থ ‘আচ্ছা পালিশ কর।’ সে বত্রিশখানা ঝকঝকে দাঁত দেখিয়ে আপনার ‘বুৎ-বালিশ কর্মে নিযুক্ত হবে।

সদস্যদের কেউ বলবেন, ‘শুভ দিবস’, কেউ ‘এই যে, কেউ একটু মৃদু হাস্য করবেন, আর কেউ মুখ খবরের কাগজের আড়ালে রেখেই কাগজখানা ঈষৎ দুলিয়ে দেবেন। ইতিমধ্যে আপনার কফি এসে উপস্থিত। ওয়েটার ঠিক জানে আপনি কতটা কড়া, কতখানি চিনি আর কোন ঢঙের পেয়ালার কফি খেতে পছন্দ করেন। আপনি বলবেন, চিঠিপত্র নেই?’

অর্থাৎ গৃহিণীর ভয়ে আপনি প্রিয়াকে কাফের ঠিকানা দিয়েছেন।

জিজ্ঞেস করলেন, ‘ফোন?’

‘আজ্ঞে না। তবে ইউসুফ বে আপনাকে বলতে বলেছেন, তিনি একটু দেরিতে আসবেন। আপনি যেন না যান।’

‘চুলোয় যাক গে ইউসুফ বে। আমি জিজ্ঞেস করছি, চিঠি বা ফোন নেই?’

কাঁচামাচু হয়ে বললে, ‘আজ্ঞে না।’ জানে আজ আপনি দরাজ হাতে বখশিশ, দেবেন না।

‘যাও, চিঠির কাগজ নিয়ে এস।’

কাফের নাম-ঠিকানা-লেখা-উত্তম চিঠির কাগজ, খাম, ব্লটিং প্যান্ড যাবতীয় সাজসরঞ্জাম এক মিনিটের ভিতর উপস্থিত হবে। আপনি পাশের টেবিলে গিয়ে গভীর মনোযোগের সঙ্গে প্রেমপত্র লিখে যখন ঘণ্টাখানেক পরে আন্ডার টেবিলে ফিরে ওয়েটারকে বলবেন, চিঠিটা ডাকে ফেলতে, তখন হঠাৎ রমজান বে শুধাবে, কাকে লিখলে?’ যেন কিছুই জানে না।

চটে গিয়ে বলবেন, ‘তোমার তাতে কি?’

রমজান বে। উদাস সুরে বলবে, না, আমার তাতে কি। তবু বলছিলুম, সকালে বিলকিসের সঙ্গে দেখা। সে তোমাকে বলে দিতে বললে, তুমি যেন সাড়ে এগারোটায় ‘ফমিনা’ সিনেমার গেটে তার সঙ্গে দেখা করো।’

আরো চটে গিয়ে বলবেন, তাহলে এতক্ষণ ধরে সেটা বলো নি কেন?’

‘সাড়ে এগারোটা বাজতে তো এখনো অনেক দেরি।’

‘আঃ, সে কথা হচ্ছে না। আমি যে মিছিমিছি এক ঘণ্টা ধরে চিঠিটা লিখলুম।’

রমজান বে আরো উদাস সুরে বলবে, জানি নে, ভাই, তোমাদের দেশে প্রেমের রেওয়াজ কি। এদেশে তো জানি, প্রিয়া পাশের ঘরে, আর এঘরে বসে প্রেমিক পাতার পর পাতা প্রেমপত্র লিখে যাচ্ছে।’

এতক্ষণে একটা মুখরোচক আলোচনার বিষয়বস্তু উপস্থিত হয়। রেশনশপ খোলামাত্ৰই মেয়ে-মদে যে রকম দোকানের ভিতর বাঁপিয়ে পড়ে, তামাম আড্ডা ঠিক সেই রকম প্ৰেমপত্র লেখার সময়-অসমিয়, মোকা-বে-মোকা, কায়দা-কেতা সম্বন্ধে আলোচনা জুড়ে দেবে।

ক্ৰমে ক্রমে আলোচনার বিষয়বস্তু হটতে হটতে পৌঁছবে সেই সনাতন প্রশ্নে, কোন দেশের রমণী সব চেয়ে সুন্দরী হয়।

অবাস্তর নয়, তাই নিবেদন করি, দেশ-বিদেশ ঘুরেছি, অর্থাৎ ভ্যাগাবিন্ড হিসাবে আমার ঈষৎ বদনাম আছে। কাজেই আমাকে কেউ শুধান কোন দেশের রান্না সবচেয়ে ভাল, কেউ শুধান, তুলনাত্মক কাব্যচর্চার জন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশস্ততম, আর অধিকাংশ শুধান, কোন দেশের রমণী সব চেয়ে সুন্দরী?

আমি কলির পরশুরামের স্মরণে উত্তর দি, ‘এনারা আছেন, ওনারাও আছেন।’ কারণ যাঁরা দেশ-বিদেশ ঘোরেন নি, তাদের সঙ্গে এ আলোচনাটা দানা বাঁধে না, বড্ড একতরফা বক্তৃতার মত হয়ে যায়, আর সবাই জানেন, বক্তৃতা আড্ডার সব চেয়ে ডাঙর দুশমন।

এ সংসারে যদি কোনো শহরের সত্যতার হক্ক থাকে, উপযুক্ত প্ৰাণাভিরাম বিষয় নিয়ে আলোচনা করার তবে কসম খেয়ে বলতে পারি, সে শহর কাইরো। কারণ কাইরোতে খাঁটি বাসিন্দারূপে যুগ যুগ ধরে আছে গ্ৰীক, আরবী, তুর্কী, হাবশী, সুদানী, ইতালিয়, ফরাসিস, ইহুদি। এবং আরো বিস্তর চিড়িয়া। এদের কেউ কেউ বোরখা পরেন বটে, তবু অক্লেশে বলা যেতে পারে, কাফের দরজার দিকে মুখ করে বসে আড্ডা অনায়াসে নিজের মুখে ঝাল খেয়ে নিতে পারে!

আর শীতকাল হলে তো পোয়া বারো। কাইরোতে বছরে আড়াই ফোটা বৃষ্টি হয়, সাহারার শুকনো হাওয়া যক্ষ্মারোগ সারিয়ে দেয়, পিরামিড কাইরোর বাইরেই ঠায় বসে, ফুর্তি-ফার্তির নামে কাইরো বে-এক্তিয়ার, মসজিদ কবর কাইরো শহরে বে-শুমার, শীতকালে না-গরম-না-ঠাণ্ডা আবহাওয়া, সবসুদ্ধ জড়িয়ে-মাড়িয়ে কাঁইরো টুরিস্টজনের ভূস্বৰ্গ এবং টুরিস্টদেরও বটে।

তদুপরি মার্কিন লক্ষপতিরা আসেন নানা ধান্দায়। তাদের সন্ধানে আসেন তাবৎ দুনিয়ার ডাকসাইটে সুন্দরীরা। তাদের সন্ধানে আসেন। হলিউডের ডিরেক্টররা এবং তাঁরা সঙ্গে নিয়ে আসেন আরেক বঁটাক সুন্দরী।

কিন্তু থাক সুশীল পাঠক, তুমি নিশ্চয়ই জানো, কামিনী-কাঞ্চন সম্বন্ধে আলোচনা শাস্ত্রে নিষেধ। শুরুর বারণ।

***

মিশরী আড্ডাবাজরা (দাঁড়ান, ব্যাকরণে ভুল হয়ে গেল, মিশরী মাত্রই আড্ডাবাজ : এমন কি সাদ জগলুল পাশা পর্যন্ত দিনে অন্তত একবার আড্ডার সন্ধানে বেরোতেন। তবে হাঁ, তিনি কোনো টেবিলে গিয়ে বসলে কেউ সাহস করে সে টেবিলের ত্ৰিসীমানায় ঘেঁষত না। সেখান থেকে তিনি চোখের ইশারায় একে ওঁকে তাঁকে ডেকে নিয়ে আড্ডা জমাতেন) দৈবাৎ একই আড্ডায় জীবন কাটান। বিষয়টা সবিস্তর বুঝিয়ে বলতে হয়।

এই মনে করুন, আপনি রোজ আপিস ফেরার পথে ‘কাফে দা নীলে’র উত্তর-পূর্ব কোণে বসেন। সেই টেবিলটায় আপনার জন-পাঁচেক দোস্ত বসেন। আড়া ফুল ষ্ট্রেনাথ জন দশ-—সবাই কিন্তু সব দিন এ আড্ডাতেই আসেন না। তাই হরে-দরে আপনার টেবিলে জন পাঁচ-সাত নিয়মিত উপস্থিত থাকেন।

এ ছাড়া আপনি সপ্তাহে একদিন—জোর দুদিন, বাড়ির পাশের সেমিরামিস কাফেতে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে বসেন। এ আড্ডার সদস্যরা কিন্তু আপনার কাফে দ্য নীলের সদস্যদের বিলকুল চেনেন না। এঁরা হয়ত চ্যাংড়ার দল, কলেজে পড়ে, কেরানীগিরি করে, বেকার, কিংবা ইনশিওরেন্স এজেন্ট (তার অর্থও বেকার)। এদের আলোচনার বিষয়বস্তু রাজনীতি, অর্থাৎ কোন পাশার বউ কোন মিনিস্টারের সঙ্গে পরকীয় করেন বলে তাঁর বোনপো পাটিতে ভালো নোকরি পেয়ে গেল, কিংবা আলোচনার বিষয়বস্তু সাহিত্য, অর্থাৎ কোন প্রকাশক একহাজারের নাম করে তিন হাজার ছাপিয়ে বেশ দু’পয়সা কমিয়ে নিয়েছে। তা ছাড়া অবশ্যই দুনিয়ার হাজারো জিনিস নিয়ে আলোচনা হয়, তা না হলে আড্ডা হবে কেন। এ আড্ডার সদস্যদের সবাই সবজান্তা। এঁরা মিশর তথা তাবৎ দুনিয়ার এত সব গুহ্যু এবং গরম গরম খবর রাখেন যে এদের কথাবার্তা, হাবভাব দেখে আপনার মনে কোনো সন্দেহ থাকবে না যে এদের প্রত্যেকের চোখের সামনে এক অদৃশ্য, অশ্রুত টেলিপ্রিন্টার খবর জানিয়ে যাচ্ছে এবং সে খবরের যোগান দিচ্ছেন রাশার বেরিয়া, জার্মানির হিমালয় আর কলকাতার টেগার্ট। রোজ বাড়ি ফেরার সময় আপনি তাজ্জব মানবেন, এদের সাহায্য ছাড়া মিশর তথা দুনিয়ার বাদবাকি সরকারগুলো চলছে কি করে। আপনার মনে আর কোনো সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকবে না যে, এদের যদি মস্কো, বার্লিন, লন্ডন, দিল্লির বড়কর্তা বানিয়ে দেওয়া হয়, তবে দুনিয়ায় কুল্পে সমস্যার সাকুল্য সমাধান এক লহমায়ই হয়ে যাবে। মনে মনে বললেন, ‘হায় দুনিয়া, তুমি জানছে না। তুমি কি হারাচ্ছে।’

আপনি এদের চেয়ে বছর দশেক বড়, তাই এরা আপনাকে একটুখানি সমীহ করে, যদিও আড় না হয়েই বিড়ি টানে। কারণ এদেশে সে রেওয়াজটা তেমন নেই। আপনি নিতান্ত বিদেশী বলেই এ আড্ডায় ছিটকে এসে পড়েছেন। এদের কাউকে পয়লা আড্ডায় নিয়ে গিয়ে কোনো লাভ নেই। আমি নিয়ে গিয়েছিলুম; বেচারী সেখানে রাটি কাড়ে নি যদ্যপি দুসর আড্ডাতে সে-ই তড়পাতো সব চেয়ে বেশি।

তা ছাড়া আপনি মাসে এক দিন কিংবা দুদিন শহর থেকে মাইল তিনেক দূরে একটা কাফেতে যান। আপনার এক বন্ধু সে কাফেটারই উপরতলায় থাকেন। খাসা জায়গায়সামনেই নীল নদ বয়ে যাচ্ছে। আপনারই বন্ধু এখানকার এ-আড্ডার সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। র্ত্যকে প্রথম খুঁজবেন কাফেতে-সেখানে না পেলে অবশ্য তাঁর ফ্ল্যাটে যেতে পারেন, তাতে কিন্তু কোনো লাভ নেই।

এ কাফে আপনাকে উদ্বাহু হয়ে অভ্যর্থনা করবে যেন আপনি অনেক দিনের হারিয়েযাওয়া ফিরে-পাওয়া ভাই। কারণ আপনি এখানে আসেন কালেভদ্রে। আপনাকে পেয়ে এঁদের বিশেষ আনন্দ কারণ পক্ষাধিক কাল ধরে তাঁরা যে সব বিষয়ে কেটেকুট ঘষে পিষে চাটনি বানিয়ে ফেলেছিলেন সেগুলো তারা নূতন করে হাড়িকাটে ঢুকিয়ে রাম-দা ওঁচাবেন। আপনার রায় জানতে চাইবেন। যে রায়ই দিন না কেন আপনার উদ্ধার নেই। আপনি যদিও গাঁধীর দেশের লোক-আপনি অবশ্য একশ বার ওঁদের বলেছেন যে, গাঁধীর সঙ্গে আপনার কোনো প্রকারে সাক্ষাৎ যোগাযোগ নেই, কিন্তু তাতে করে কোনো ফায়দা ওৎরায় না।—যদিও আপনার জ্ঞানগম্যতে কারো কোনো সন্দেহ নেই, কারণ আপনি গুহা। ষষ্ঠেন্দ্ৰিয় ধারণ করেন ইত্যাদি ইত্যাদি। তবু স্বীকার করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।

আপনি নিৰ্ঘাৎ শেষ বাস মিস করবেন। বন্ধুর ফ্ল্যাটে সোফার উপর চতুর্থ যাম যাপন করে। পরদিন সকাল বেলা বাড়ি ফিরবেন।

 

আড্ডা- সৈয়দ মুজতবা আলি প্রশ্ন-উত্তরঃ 

…….. খুব শীঘ্রই শিক্ষালয় ওয়েবসাইটের পক্ষ থেকে এখানে আড্ডা প্রবন্ধের প্রশ্নের উত্তরগুলি প্রদান করা হবে। শিক্ষালয় ওয়েবসাইটের সকল প্রকার আপডেট দেখতে নিয়মিত ভিজিট করো শিক্ষালয় ওয়েবসাইট। 

একাদশ শ্রেণি বাংলা সেমিষ্টার ১ এর বাংলা পড়া ও নোট দেখতে নিম্নের ছবিতে ক্লিক/টাচ করতে হবে

class-eleven-bengali-semester-1

একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির সব বিষয়ের সিলেবাস ও নম্বর বিভাজন দেখতে এই লিঙ্কে ক্লিক/টাচ করতে হবে 

শিক্ষালয় ওয়েবসাইটের কিছু গুরুত্বপূর্ণ লিঙ্ক নিম্নে প্রদান করা হলোঃ

শিক্ষালয় ওয়েবসাইটের সকল প্রকার নোট, সাজেশন, প্রশ্নপত্র ও মক টেষ্টের সুবিধা গ্রহণ করতে নিম্নের ছবিতে ক্লিক/টাচ করে বিষদ তথ্য জেনে নাওঃ 

paid courses

You cannot copy content of this page

Need Help?