মহানুভবতা- অনুপম ধর

মহানুভবতা- অনুপম ধর

শিক্ষালয় ওয়েবসাইটের পক্ষ থেকে মহানুভবতা- অনুপম ধর গল্পটি পোষ্ট করা হলো। শিক্ষালয় ওয়েবসাইটে প্রকাশিত অন্যান্য গল্প, কবিতাগুলি পাঠ করতে ওয়েবসাইটের বিবিধ বিভাগ অনুসরণ করতে হবে। 

শিক্ষালয় ওয়েবসাইটের সকল প্রকার আপডেট লাভ করতে মোবাইল স্ক্রিনের বা’দিকের নিম্নের অংশে থাকা বেল আইকনটিতে (🔔) টাচ করে শিক্ষালয় ওয়েবসাইটের নোটিফিকেশন অন করে রাখুন।

মহানুভবতা- অনুপম ধরঃ

প্রতিদিন সকালে অ্যালার্ম ঘড়ির অত্যাচারকে উপেক্ষা করে নির্ধারিত সময়ের থেকে খানিকক্ষণ বেশি ঘুমোনই বিমলের চিরকালীন অভ্যাস। ছোটবেলায় যখন পড়াশোনা ছিল, তখন তার এই বদভ্যাসের জন্য মা-বাবার কাছে কতোই না বকাঝকা খেয়েছে সে। আর এখন, যখন সে পড়াশোনার কঠিন গন্ডিকে খানিকটা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উপেক্ষা করে পরিবারের একপ্রকার অমতেই নিজের ব্যবসাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে, তখনও তার সকালে সময়ের পরে ওঠার অভ্যাস একই রয়ে গেছে। 

আজ বিমলের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ দিন। প্রথাগত পড়াশোনায় অনাগ্রহী বিমল উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছিল ফার্স্ট ডিভিশনেই। কিন্তু তবুও সে তার পরিবারের অমতেই পড়াশোনার পাঠ সাঙ্গ করে অভিন্ন হৃদয় বন্ধু শ্যামলের সাথে ট্র্যাভেল এ্যান্ড টুরিজমের ব্যবসা শুরু করে। ছোটবেলা থেকেই বিমল নতুন নতুন জায়গায় ঘুরতে ভালোবাসতো। আর তার বন্ধু শ্যামলের ছিল বিবিধ ভাষা রপ্ত করার নেশা। তাই দুই বন্ধু উচ্চমাধ্যমিকের পরে ট্র্যাভেল এ্যান্ড টুরিজমের ব্যবসা শুরু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই বিষয়ে সকল প্রকার প্রতিবন্ধকতাকে তারা শুধুমাত্র নিজেদের ইচ্ছাশক্তির জোড়েই অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছিল। এক বছরের মধ্যেই তাদের ‘চলো ঘুরে আসি’ কোম্পানি সাফল্যের মুখ দেখে। ইতিমধ্যেই তারা তাদের শহর হলদিবাড়ি থেকে দার্জিলিং, সিকিম, গ্যাংটক, মসৌরি, জম্মু ও কাশ্মীর, লাদাখ, কেদারনাথ, কন্যাকুমারী, রাজস্থান প্রভৃতি স্থানে ট্যুর করে ফেলেছে। তাদের সাফল্যে এখন তাদের পরিবারও পূর্বের মনোমালিন্য দূর করে তাদের প্রতি সকল প্রকার সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। তাদের কোম্পানির সুখ্যাতি হলদিবাড়ি অতিক্রম করে দূরবর্তী শহরগুলিতেও ছড়িয়ে পড়েছে।

আজ বিমল-শ্যামলের ‘চলো ঘুরে আসি’ কোম্পানি তাদের প্রথম বছরের পথ চলার বৃত্ত সম্পূর্ণ করতে চলেছে। তাদের জীবনের এই বিশেষ দিনে তারা এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। আর সেই অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হয়ে আসছেন, বিশিষ্ট সমাজসেবক বিপিনবিহারী মজুমদার। তাই আজ সকালে সকলকে অবাক করে দিয়ে বিমল জেগে উঠেছে তার অ্যালার্ম ঘড়িরও আগে। যে বিমল কোনদিন সকালে দশটার আগে তৈরি হতে পারে নি, সেই আজ সকাল পাঁচটায় প্রস্তুত ! বিশেষ অতিথিকে স্টেশনে অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে আসার গুরুদ্বায়িত্ব তার কাঁধে দিয়ে বন্ধু শ্যামল অন্যান্য আয়জনে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে। সকাল-সকাল প্রস্তুত হয়ে বিমল বাবা-মাকে প্রণাম করে তার প্রিয় স্কুটি নিয়ে স্টেশনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। তার জীবনের এই বিশেষ দিনটি যে এভাবে স্মরণীয় হয়ে উঠবে, তা তার কল্পনার বাইরে ছিল ! 

বিশেষ দিনের উত্তেজনায় আজ স্বাভাবিকের থেকে বেশ কিছুটা জোড়েই স্কুটি চালিয়ে বিমল স্টেশনের দিকে ছুটে চলেছে। বাড়ি থেকে বেরিয়েই বিমল স্মৃতির সাগরে ভেসে যেতে যেতে বিপিনবিহারী বাবুকে অভ্যর্থনা জানাতে স্টেশনের উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলছিল। তার স্মৃতিপটে একে একে ভেসে আসছিল কীরূপে সে ও তার বন্ধু তিলে তিলে তাদের এই ব্যবসাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে- সেই সকল কথা। হঠাৎ করেই মোবাইলের রিংটোনের শব্দে সে বাস্তবের মাটিতে নেমে আসে। রাস্তার ধারে স্কুটি থামিয়ে পকেট থেকে সদ্য কেনা নতুন মোবাইলটা বের করতেই বন্ধু শ্যামলের মুখটা ভেসে ওঠে। ওপর প্রান্ত থেকে করা প্রশ্নের উত্তরে স্মিত হেসে বিমল জানায়, “না না, আজ কাউকেই ডাকতে হয় নি রে। আমি তো রেডি হয়ে বেরিয়েও পড়েছি। এখন প্রান্তিক ভবনের কাছাকাছি আছি। ভাবছি একবার ভবনের যে ঘরটা বিপিনবিহারী বাবুর জন্য বুক করা হয়েছে, সেটা কতোটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আছে দেখে নিয়ে সোজা স্টেশনে চলে যাবো।”

বন্ধুর সাথে কথোপকথন শেষ করে বিমল তার স্কুটি স্টার্ট করে সোজা প্রবেশ করে প্রান্তিক ভবনে। সেখানকার যাবতীয় ব্যবস্থা পরিদর্শন করে সে ফোন করে নেয় তাদের অফিসের কর্মী জয়ন্তকে। বিপিনবিহারী বাবুর দেখাশোনার যাবতীয় দ্বায়িত্ব দুই বন্ধু নিশ্চিন্তে অর্পন করেছে তাদের অফিসের অনুগত কর্মী জয়ন্ত সেনগুপ্তের বিশস্ত হাতে। জয়ন্তর বাড়ি স্টেশনের কাছেই। তাই তাকে সরাসরি স্টেশনেই আসতে বলে দেয় বিমল; আর সেও রওনা দেয় স্টেশন অভিমুখে।

স্টেশনে ঢোকার ঠিক আগের গলিটায় এসে একটা ভিড় দেখে বিমল তার স্কুটিটা থামায়। খানিকটা এগিয়ে গিয়ে সে দেখে একজন রুগ্ন বৃদ্ধ স্টেশনের বাইরে রাস্তার পাশে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করছে। আর সমবেত মানুষ সেই বৃদ্ধের পরিচয় তথা এই স্থানে তার এভাবে পড়ে থাকার বিষয়ে নানান মন্তব্য ছুড়ে দিলেও বৃদ্ধের প্রতি কোনপ্রকার সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে না! এদিকে বিমল ইতিমধ্যেই লক্ষ্য করেছে যে, তিস্তা-তোর্সা এক্সপ্রেস স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে। অর্থাৎ বিপিনবিহারী বাবু তাদের জন্য স্টেশনে অপেক্ষারত। মুহুর্তের মধ্যে বিমল কি করবে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলে। পাশের দোকান থেকে একটা জলের বোতল কিনে নিয়ে সে বৃদ্ধের কাছে ছুটে যায়। বৃদ্ধের তৃষ্ণার্ত মুখে কাঙ্খিত জল প্রদান করে বিমল একটি টোটো ডেকে নেয়। সমবেত জনতার কৌতুহলী দৃষ্টির সম্মুখে বিমল সেই রুগ্ন বৃদ্ধকে নিয়ে টোটোতে উঠে বসে ও টোটোচালককে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে যাওয়ার নির্দেশ প্রদান করে।

হাসপাতালে পৌঁছে সেই বৃদ্ধকে ভর্তি করার পরে নিজের ফোন নম্বর হাসপাতালে দিয়ে বিমল যখন পুনরায় স্টেশনে ফিরে আসে তখন স্টেশন প্রায় জনহীন। নিজের স্কুটিটা বিমল রাস্তার পাশেই ফেলে টোটো নিয়ে ছুটে গিয়েছিল হাসপাতালে। এবারে সেই স্কুটি নিয়ে সে দ্রুত রওনা হলো প্রান্তিক ভবনের দিকে। পথে যেতে যেতে তার চিন্তা ও দুঃশ্চিতা দুইই হচ্ছিল। তার একদিকে মনে হচ্ছিল সেই রুগ্ন অসহায় বৃদ্ধের কথা, যার পাশে সে এই মুহুর্তে থাকতে চাইছিল; অপরদিকে তার মনে হচ্ছিল বিপিনবিহারী বাবু হয়তো তার অভ্যর্থনা না জানানোর কারণে অসন্তুষ্ট হয়ে থাকতে পারেন। 

প্রান্তিক ভবনের গেটের কাছেই বিমলের দেখা হয়ে গেল জয়ন্তর সাথে। তাকে দেখেই উত্তেজিত কন্ঠে জয়ন্ত বলে,“আরে বিমলদা, কোথায় ছিলে তুমি? তোমাকে কতবার ফোন করছি, ফোনটাও ধরছো না!” পকেটে হাত দিয়ে বিমল বুঝতে পারে তার সদ্য কেনা মোবাইলটা সে তাড়াহুরোর মধ্যে কোথাও হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু ফোনের জন্য হতাশ হবার অবকাশ নেই এখন বিমলের। বিমল তৎক্ষণাৎ জয়ন্তর কাছে জানতে চায়, “বিপিনবিহারী বাবু কি আমার অনুপস্থিতির জন্য মনঃক্ষুন্ন হয়েছেন? উনি কি আমার কথা তোমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করেছেন?” বিমলের এই প্রশ্নের উত্তরে জয়ন্ত যা জানায় তাতে বিমল হতাশ হয়ে পড়ে। জয়ন্ত জানায় যে, সে যথাসময়েই স্টেশনে পৌঁছে গিয়েছিল, কিন্তু বিপিনবিহারী বাবু আসেন নি! বিমল সাথে সাথেই জয়ন্তর ফোন থেকে বন্ধু শ্যামলকে ফোন করে বিপিনবিহারী বাবুর সাথে যোগাযোগ করতে বলে। কিন্তু শ্যামল জানায় যে, সে জয়ন্তর কাছে আগেই বিষয়টা জেনে অনেকবার বিপিনবিহারী বাবুর সাথে যোগাযোগের প্রচেষ্টা করে ব্যার্থ হয়েছে। বিমল এই ঘটনায় ভীষণভাবে হতাশাগ্রস্ত হয় এবং বিপিনবিহারী বাবুর এমন আচরণের জন্য তার উপরে ক্ষাণিকটা ক্ষুদ্ধও হয়। 

অনুষ্ঠানের আয়োজনের ব্যাস্ততার মাঝে বিমল আর সেই রুগ্ন বৃদ্ধর শারীরিক সুস্থতার সংবাদ নিতে হাসপাতালে যেতে না পারলেও তার জন্য কিছু পথ্য এক বন্ধুর মাধ্যমে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। সন্ধ্যার অনুষ্ঠানে বিপুল সংখ্যক মানুষের আগমন ঘটে। বিমল ও শ্যামল মঞ্চে উঠে সকলের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে জানায় যে, বিশিষ্ট সমাজসেবক বিপিনবিবারী মজুমদার বিশেষ কারণবশত তাদের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারেন নি। 

যখন বন্ধু শ্যামল আগত দর্শকদের কাছে তাদের প্রতিষ্ঠানের কার্যাবলীর বিবরণ বর্ণনা করছিল, ঠিক সেই মুহুর্তে জয়ন্ত ছুটতে ছুটতে এসে বিমলকে জানায় যে, বিপিনবিহারী বাবু এসেছেন! বিমল দ্রুততার সাথে বাইরে ছুটে যায় ও বিপিনবিহারী বাবুকে পুষ্পস্তবক দিয়ে অভ্যর্থনা জানিয়ে মঞ্চে নিয়ে আসে। বিমলের মনে অসংখ্য প্রশ্নেরা এসে ভিড় করলেও সেই মুহূর্তে কোনো প্রশ্নই বিমল বিপিনবিহারী বাবুকে করতে পারে না। 

শ্যামল আনন্দের সাথে বিপিনবিহারী বাবুর আগমন ঘোষণা করে ও তার বক্তব্য শেষ করে বিপিনবিহারী বাবুকে কিছু বলবার অনুরোধ জানায়। এরপর বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিপিনবিহারী বাবু সকলকে অবাক করে দিয়ে বলেন, “আমাকে বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয় ও আমার সমাজসেবামূলক কর্মের জন্য আমাকে সন্মানিত করা হয়। কিন্তু আমি আজ আপনাদের সাথে পরিচয় করাতে চাই আপনাদের শহরেরই এমন এক তরুণের সাথে, যে নিজের স্বার্থের পরিবর্তে মানবতাকে প্রাধান্য দিয়ে আজ আমার হৃদয় জয় করেছে।” একথা বলে তিনি মঞ্চে ডেকে নেন বিমলকে এবং জানান যে, তিনি ট্রেন থেকে নেমে যখন স্টেশনের বাইরে আসেন তখন বিমলকে সেই রুগ্ন বৃদ্ধর সেবা করতে দেখেন। তিনিও অপর একটি টোটো নিয়ে বিমলকে অনুসরণ করে হাসপাতালে যান এবং সারাদিন সেই বৃদ্ধের পাশে থেকে তাকে অনেকাংশেই সুস্থ করে তুলেছেন। আর বিমলের দ্বারা পথ্য পাঠানো সেই বন্ধুকে নিয়ে তিনি এখানে উপস্থিত হয়েছেন। দর্শকদের বিপুল হাততালির মাঝে তিনি বিমলকে জড়িয়ে ধরেন এবং বলেন, “বিমলের মতো তরুণদের বর্তমান সমাজে বড়োই প্রয়োজন।” হাসপাতালে ফেলে আসা বিমলের মোবাইল ফোনটিও তিনি বিমলের হাতে তুলে দেন। আর এভাবেই দিনটি বিমলের কাছে সর্বার্থসার্থক হয়ে ওঠে।   

শিক্ষালয় ওয়েবসাইটের কিছু গুরুত্বপূর্ণ লিঙ্ক নিম্নে প্রদান করা হলোঃ

শিক্ষালয়ের সাথে ফেসবুকে যুক্ত হতে নিম্নের ছবিতে ক্লিক/টাচ করতে হবেঃ sikkhalaya

You cannot copy content of this page

Need Help?