অপুর সাহসিকতা- প্রাঞ্জেলা দে

অপুর সাহসিকতা- প্রাঞ্জেলা দে

শিক্ষালয় ওয়েবসাইটের “বিবিধ” বিভাগ থেকে যে ছড়া, কবিতা, প্রবন্ধ, ছোটগল্প, ভ্রমণবৃত্তান্ত, সাহিত্য সমালোচনা বিষয়ক প্রবন্ধ বা হাতে আঁকা ছবির কোলাজ প্রভৃতি প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, সেই উদ্যোগে অংশগ্রহণ করেছে শিক্ষালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী প্রাঞ্জেলা দে মেধাবী ছাত্রী প্রাঞ্জেলা পড়াশোনার পাশাপাশি গল্প লিখতে ভালোবাসে। এছাড়াও সে খুব সুন্দর নাচও করতে পারে। তাদের একটি নাচের ইউটিউব চ্যানেলও আছে- Dancing Queens.

প্রাঞ্জেলার লেখা “অপুর সাহসিকতা” গল্পটি আজ শিক্ষালয়ের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হলো। এই গল্পটি সকল শিশুদের আনন্দ দেবার পাশাপাশি বড়োদেরও হৃদয় জয় করবে। 

সকল পাঠকের কাছে অনুরোধ, “অপুর সাহসিকতা” গল্পটি আপনাদের ভালো লাগলে তা আপনাদের পরিচিত মানুষদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে শিক্ষালয়ের এই প্রয়াসকে সর্বার্থসার্থক করে তুলুন।

অপুর সাহসিকতা

প্রাঞ্জেলা দে

একটি গ্রামে একটি ছেলে তার পরিবারের সাথে থাকত, যার নাম ছিল অপু। অপুর বয়স ছিল দশ বছর। অপু খুবই সাহসী ও মেধাবী ছিল। সে যেমন তার নিজের বুদ্ধির জোরে গ্রামের মানুষের বিপদে তাদের পাশে দাঁড়াত ও সাহায্য করত তেমনই সে তার টক-ঝাল-মিষ্টি দুষ্টুমীর জোরে পুরো গ্রামবাসীকে অতিষ্ঠ করে তুলত।

অপু সকালে উঠে তার বন্ধুদের সাথে পাঠশালায় যেত, তারপর বিকেলে বাড়ি ফিরে আবার সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে যেত। তার বন্ধুরা ছিল শিবু, গদাই, পুঁটি আর গণেশ। তারা সবসময় একসাথেই থাকত, একসাথে পাঠশালায় যেত, পাঠশালা থেকে আসত, একসাথে খেলা করত। অপুর বাবা ছিলেন একজন সাধারণ কুমোর। তিনি অনেক প্রতিবন্ধকতা ও বিপদের সম্মুখীন হয়ে সংসার চালাতেন। অপুর মা স্বভাবে শান্ত প্রকৃতির হলেও অপু কোনো দুষ্টুমী করলে তার রণচন্তী রূপের আবির্ভাব হতো। অবশ্য সবাই অপুর মায়ের এইরূপ দেখে ভয় পেলেও অপুর ওপরে এই রূপের কোনো প্রভাব পড়ত না।

অপু অনেক বার নিজের অসামান্য সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। অপু গ্রামের জমিদারের স্ত্রীর হার চুরির থেকে শুরু করে কোনো সামান্য চাষি ভাইয়ের ক্ষেত্রে ধানচুরির প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই সে নিজের অসামান্য বুদ্ধি ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। এরকমই একটি ঘটনা হলো রামলালবাবুর খেজুর বাগান থেকে খেজুরের রস চুরির ঘটনা।

একবার গ্রামে অপুর প্রতিবেশী রামলাল বাবুর খেজুর বাগানের খেজুর গাছে শীতের দিনে ভালো রস এসেছিল। তাই তিনি কিছু লোক লাগিয়ে খেজুর গাছে মাটির কলসি বেঁধে দেন। আর সেই খেজুর বাগান দেখাশোনা করার জন্য তিনি একটি লোক রেখেছিলেন, যার নাম ঘনা। ঘনা দিনে অবশ্য খেজুর গাছের ভালোই খেয়াল রাখত; কিন্তু রাতের বেলা সে ঘুমিয়ে পড়ত। তাই দিনে একবার অন্তত রামলালবাবু বাগানে এসে সবকিছু দেখে যেতেন।

কিছুদিন সবকিছু ভালোই চলছিল। হঠাৎ একদিন তিনি দেখলেন কিছু কলসিতে রস নেই! তিনি ভাবলেন, হয়তো সেই গাছের খেজুরে রস নেই। পরদিন তিনি আবার এসে দেখলেন যে, কিছু কলসি ফাঁকা তাতে রস নেই। এরকমভাবে কিছুদিন চलল। তারপর তিনি একদিন ঘনাকে ঢেকে জিজ্ঞেস করলেন যে, সে রোজ খেজুরের রস চুরি করছে না তো? ঘনা প্রত্যুত্তরে বলল, ” না না বাবু, আমি খেটে খাওয়া মানুষ, আমি চুরি করিনি, চুরি করা মহাপাপ সে পাপের কাজ আমি করিনি।” রামলালবাবু তার কথা মেনে নিলেন। কিন্তু তিনি খুব চিন্তায় পড়ে যান যে যদি ঘনা চুরি না করে থাকে তবে আর কে করতে পারে এই চুরি। তিনি সেদিন কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে নিজের বাড়ি ফিরে যান।

পরদিন সকালে তিনি বাজার করতে হাটে গেলেন। সেখানে তার অপু ও অপুর বাবা হরিনাথের সাথে দেখা হলো। রামলালবাবু অপুর বাবার সাথে নানান কথা বলছিলেন; কথা বলতে বলতে তিনি তার এই খেজুরের রস চুরির ব্যাপারটি বললেন। অপু কান পেতে পুরো কথাটি শুনছিল। হরিনাথ পুরো ব্যাপারটি শুনে রামলালবাবুকে বলল, “তাহলে আপনি এক কাজ করেন, একটি লোক রাখেন দেখাশোনার জন্যে।” রামলালবাবু জবাব স্বরূপ বললেন, “রেখেছি হরি, কিন্তু সে বেটা রাতে পরে পরে ঘুমোয়। আর সে বড়ো ভীতু, চোর ধরা তার কম্ম নয়।” হঠাৎ অপু বলে উঠল, “তবে কাকা আমি একবার চেষ্টা করে দেখব চোর ধরতে পারি কী না?” রামলালবাবু হেসে বললেন, “তুই একা পারবি রে অপু, চোর ধরা বুঝি এতই সহজ তোর জন্য?” অপু বলল, “আমি একা কই গো! আমার বন্ধুরা আছে তো! শিবু গদাই, পুঁটি, গণেশ ওরা আমায় চোর ধরতে সাহায্য করবে।” অপুর বাবা অপুকে ধমক দিয়ে বলল, “তুই চুপ কর তো বাজে বকিস নে।” রামলালবাবু হরিনাথকে অপুকে বকা না দেওয়ার ঈশারা দিয়ে বলল, ” আহা! হরি, অপুকে বোকো না ও তো আগেও অনেকবার এমন অসাধ্য সাধন করেছে। ও যা করতে চাইছে ওকে করতে দাও।” অপু একথা শুনে খুব খুশি হয়ে বলল, “কাকা তাহলে আজ তুমি যখন খেজুরের বাগানে যাবে তখন আমায় সাথে নিয়ে যেও।” রামলালবাবু মাথা নেড়ে অপুর কথায় সম্মতি জানাল।

তারপর অপু ও হরিনাথ বাড়ি ফিরে এল। হরিনাথ অপুকে সারারাস্তা বকতে বকতে নিয়ে এল; কিন্তু অপু সারারাস্তা অন্যমনস্ক হয়ে ছিল। হরিনাথ তার বাড়ির চৌকাঠে ঢুকতে না ঢুকতেই তার স্ত্রী বাইরে বেরিয়ে এল। সে তার স্ত্রীকে রাগ হয়ে বলল, “দেখো, তোমার ছেলে বাজারে গিয়ে কী কান্ডি করে এসেছে।” অপুর মা অপুর দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুই আবার কী কাণ্ড করেছিস? তুই কী কোনোদিনও সুধরোবি না!” অপু বলल, “মা আমি কিছু করিনি বাবা এমনি অমন কথা বলছে। মা আমি মাঠে গেলাম শিবু, গদাইদের সঙ্গে কথা বলতে হবে।” বলে সে ছুটে বেরিয়ে গেল। তখন হরিনাথ তার স্ত্রীকে সবকথা খুলে বলল। এসব কথা শুনে অপুর মা খুবই চিন্তিত হয়ে পড়ল।

অপু মাঠে গিয়ে দেখল শিবু, গদাই, পুঁটি, গণেশ ওরা সবাই মাঠে খেলছে। অপুকে দেখে ওরা খেলা থামিয়ে অপুর দিকে ছুটে এল। পুঁটি বলল, “কী রে অপু, এত দেরি করে এলি কেন? আমরা কখন থেকে তোর জন্য অপেক্ষা করছি।” অপু ওদের সবাইকে হাটে কী কী হয়েছে তা খুলে বলল। তারপর গণেশ বলল, “তাহলে এবার আমরা চোরকে ধরার জন্য কী করব গো, অপুদা? কিছু ভেবেছো?” “আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে কিন্তু তোদেরও কিন্তু আমায় সাহায্য করতে হবে”- অপু বলল। শিবু বলল, “অপু তুই যা যা করবি আমরা সবাই তাতে তোকে সাহায্য করব, এবার বল তোর পরিকল্পনাটা কী ?” তারপর অপু তাদেরকে তার পরিকল্পনার কথা বলল। ওরা সবাই পরিকল্পনাটি শুনে খুব খুশি হয়ে গেল। তারপর গদাই বলল, “চোর ধরার জন্য এটা খুব ভালো বুদ্ধি। যখন তোকে, রামলালকাকা নিতে আসবে তখন আমাদের তুই ডেকে দিস।” তারপর ওরা নিজের নিজের বাড়িতে চলে গেল।

তারপর বিকেল নাগাদ রামলালবাবু হরিনাথের বাড়ির সামনে এসে অপুর নাম ধরে ডাকতেই অপু ছুটে বাইরে বেরিয়ে এসে রামলালবাবুকে দেখে তার মুখে এক রাশ হাসি ফুটে ওঠে। তারপর অপু তার বন্ধুদের ডেকে নিয়ে এসে তারা সবাই অর্থাৎ অপু, হরিনাথ, রামলালবাবু ও অপুর বন্ধুরা খেজুরবাগানের দিকে রওনা দেয়। তারা পাঁচমিনিটের মধ্যে সেখানে পৌঁছে যায়। সেখানে গিয়ে রামলালবাবু ঘনাকে ডেকে বলল, “ঘনা, শোন অপু যা যা বলবে তাই তাই তুই কর।” ঘন্য এ কথাকে সমর্থন জানিয়ে মাথা নাড়াল। তারপর অপু ঘনার কানে কানে তার পরিকল্পনার কথা বলল। তারপর ঘনা পরিকল্পনাটি শুনে এক ছুটে তার বাড়ির থেকে কোদাল ও দড়ির একটি জাল নিয়ে আসল। আর অপুর ইশারায় শিবু, , গদাই, গণেশ, পুঁটি অনেক শুকনো পাতা সংগ্রহ করে আনে। তারপর ঘনা খেজুর গাছের সারির প্রথম গাছটির নীচে গর্ত খুড়ল। সেই গর্তে একটি মানুষ পুরোপুরিভাবে ফেঁসে যেতে পারবে। একবার সেই গর্তে পড়লে আর বেরোতে পারবে না কেউই। তারপর সেই গর্তের ওপর একটি দড়ির জাল ও তার ওপরে অনেক গুলি শুকনো পাতা ছড়িয়ে দেওয়া হয়। খেজুর বাগানের প্রায় সর্বত্রই এরকম শুকনো পাতা ছিল। তাই কারো এই শুকনো পাতা দেখে সন্দিহান হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। তারপর তারা সবাই নিজের নিজের বাড়ি চলে যায়।

হঠাৎ রাত ৩টা নাগাদ ঘনা রামলালবাবুর বাড়ির সামনে এসে চোর চোর বলে জোরে জোরে চিৎকার করতে লাগে । সেই চিৎকার শুনে রামলালবাবু সহ হরিনাথ ও অপুও জেগে ওঠে। রামলালবাবু, হরিনাথ ও অপু বাইরে এসে দেখল ঘনা হাঁপাচ্ছে; আর বারবার চোর চোর বলে চিৎকার করছে। তারপর রামলালবাবু উত্তেজনার স্বরে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে, তুই এত হাঁপাচ্ছিস কেন?” ঘনা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “বাবু চোর চোর ফাঁদে ধরা পড়েছে। তাড়াতাড়ি চলুন নাহলে সে যে পালিয়ে যাবে।” একথা শুনে অপু এক ছুটে বাগানের দিকে রওনা দেয়। অপুর পেছন পেছন হরিনাথ, ঘনা ও রামলালবাবুও বাগানে গেলেন। গিয়ে দেখলেন সত্যি সত্যিই সেই গর্তে একটা লোক ফেঁসে গেছে। সে ভিতর থেকে চিৎকার করে বলছে, “আমাকে কেউ বাঁচাও, আমি মরতে চাই না, আমি আর কখনো চুরি করব না, আমাকে দয়া করে বাঁচাও।” তারপর সবাই মিলে সেই ব্যাক্তিটিকে তুললে সে রামলালবাবুর কাছে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইল। সেই চোরটি অপুর দিকে তাকিয়ে বলল, “বাবু, তোমার বুদ্ধির কোনো তুলনা হয় না।” তারপর রামলালবাবু অপুর বুদ্ধির প্রশংসা করে বলল, “অপু তুই আজ আমার খুব উপকার করেছিস তাই তুই আর বন্ধুরা যখন ইচ্ছে তখন আমার বাগানে এসে খেজুর আর খেজুরের রস নিয়ে যেতে পারিস কেউ তোদেরকে বারণ করবে না।” অপুর মা-বাবাও অপুর খুব প্রশংসা করেন। এভাবেই পরবর্তীতে আরও অনেক সময়ে নিজের সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে অপু.

শিক্ষালয় ওয়েবসাইটের বিবিধ বিভাগে বাংলা কাব্য, কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প প্রভৃতির এক ক্ষুদ্র সংস্করণ তৈরি করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়েছে। শিক্ষালয় ওয়েবসাইটের ফলোয়াররা তাদের লেখা গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, ভ্রমণ বৃত্তান্ত, সাহিত্য সমালোচনা বিষয়ক প্রবন্ধ বা হাতে আঁকা ছবির কোলাজ শিক্ষালয় ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে চাইলে নিম্নের লিঙ্কে তা পাঠাতে পারেন। 

sikkhalaya what's app

Submit Your Content 

শিক্ষালয় ওয়েবসাইটের সকল আপডেট নিয়মিত লাভ করতে নিম্নের ফর্মটি যথাযথভাবে পূরণ করুনঃ

sikkhalaya
শিক্ষালয়, অনুপম ধর

You cannot copy content of this page

Need Help?